হাঁড়িভাঙা আম চাষে ভাগ্যবদল

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায় ধানি জমিতেও গড়ে উঠেছে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান। বাগানে ঝুলছে থোকায় থোকায় আম। ছবিটি সম্প্রতি উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়ন থেকে তোলা
ছবি: প্রথম আলো


একসময় যে ইউনিয়নজুড়ে দেখা যেত ধানখেত, এখন সেই ইউনিয়নজুড়ে শুধুই চোখে পড়ে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান। যাঁরা একসময় শ্রমিকের কাজ করতেন, তাঁরাও বাড়ির সামনে–পেছনে ভেতরে ফাঁকা জায়গায় আমগাছ লাগিয়েছেন। হাঁড়িভাঙা আম চাষ করে তাঁরা ইতিমধ্যে নিজেদের ভাগ্য বদলেও ফেলেছেন। আমের বাগানে ঘেরা এই ইউনিয়নের নাম ‘খোড়াগাছ’। এর অবস্থান রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলায়।

কৃষক ও কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৫ বছর আগেও মিঠাপুকুর উপজেলায় এভাবে আমের চাষ হতো না। সবাই পড়ে থাকতেন ধান, তামাক, সবজি চাষ নিয়ে। কিন্তু এঁটেল মাটির এ এলাকায় আম চাষ যে অনেক বেশি লাভজনক, সে বিষয়টি প্রথমে বুঝতে পারেন খোড়াগাছ ইউনিয়নের টেকানী গ্রামের লুৎফর রহমান। তাঁর সাফল্য দেখে এগিয়ে আসেন আরও অনেকেই। আগে যাঁরা জমিতে ধানসহ অন্য ফসলের চাষ করতেন। তাঁরাও আম চাষে ঝুঁকে পড়েন। লাভ বেশি হওয়ায় আম চাষ হয়ে উঠে এখানকার মানুষের জীবিকার প্রধান অবলম্বন।

উপজেলা কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে ১০ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙা আমের চাষ হয়েছে। আমচাষির সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। যাঁদের জমি নেই, তাঁরা বসতবাড়ির আঙিনা, ঘরের পেছনে, অলিগলিতে সব জায়গায় হাঁড়িভাঙা আমের গাছ রোপণ করেছেন। ফলনও হয়েছে ভালো। পাঁচ বছর বয়সী আমের বাগানে একরপ্রতি লাভ হচ্ছে দুই-তিন লাখ টাকা। এ কারণে এলাকার লোকজন ধানি জমিতেও আমের চাষ শুরু করেছেন।

খোড়াগাছ গ্রামের ফজলার রহমান জানান, আগে তিনি এক একর জমিতে ধান ও আলুর চাষ করতেন। আট বছর আগে সেই জমিতে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান করেছেন। জমির ফসল বিক্রি করে আগে বছরে তাঁর লাভ হতো ৩০-৪০ হাজার টাকা। গত বছরে তিনি বাগানের আম বিক্রি করে পেয়েছিলেন দুই লাখ টাকা। এবার আরও বেশি লাভের আশা করছেন তিনি।

পাঁচ একর জমিতে আমের বাগান করেছেন পদাগঞ্জ গ্রামের বকুল মিয়া। গত তিন বছরে আম বিক্রি করে গড়ে তিনি আয় করেন ১৫ লাখ টাকা। তিনি বলেন, ধান চাষ আর আম চাষে লাভের পার্থক্য হচ্ছে আকাশ–পাতাল।

পদাগঞ্জ গ্রামে ঢুকতেই জেলেখা খাতুনের বাড়ি। স্বামী আফজালুল হক মারা যাওয়ার পর তিন সন্তান নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করতেন তিনি। ১০ বছর আগে তিনি স্বামীর রেখে যাওয়া ১৮ শতক জমিতে হাঁড়িভাঙা আমের গাছ লাগান। তিন বছরের মাথায় সেই গাছগুলোর আম বিক্রি করে বাড়িতে করেন মুরগির খামার। এরপর থেকে বদলে যেতে থাকে তাঁর ভাগ্যের চাকা। গত সাত বছরে আম চাষ ও মুরগির খামার করে জেলেখা ৭৫ শতক জমি কিনেছেন। স্কুলপড়ুয়া দুই সন্তানকে নিয়ে তাঁর সুখের সংসার। জেলেখা বলেন, ‘আগোত বারো মাস কষ্ট আছিল। আমে হামার কষ্ট মুছি দেছে।’

খোড়াগাছ ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় আমের বাজার হচ্ছে পদাগঞ্জ। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা এ হাটে আসেন আম কেনার জন্য। ঢাকার আম ব্যবসায়ী রোস্তম আলী বলেন, দিন যাচ্ছে, বাজারে হাঁড়িভাঙা আমের চাহিদাও বাড়ছে। আম ঘিরে ছোট–বড় অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে হাজারো মানুষের।

মিঠাপুকুর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসাইন বলেন, মিঠাপুকুর উপজেলায় প্রতিবছর হাঁড়িভাঙা আমের চাষ বাড়ছে। লাভ বেশি হওয়ায় লোকজন ধানি জমিতে আমের বাগান করছেন। গত বছরের চেয়ে এ বছর ৩০ হেক্টর ধানি জমিতে আমের চাষ বেড়েছে। পুরো উপজেলায় ১০ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে ৩ হাজার ৬০০টি আমের বাগান রয়েছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে নিরাপদ আম চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক অশোক কুমার রায় বলেন, এ আমের তুলনা হয় না, খুবই সুস্বাদু। জুনের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত পাওয়া যায়।

কাঁচা অবস্থায় আমের রং সবুজ, পুষ্ট হলে কিছুটা সাদাটে হয়। পাকা অবস্থায় বোঁটার কাছাকাছি বেশ হলুদ হয়। ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে হয় হালকা হলুদ। আঁশবিহীন এ আমের আঁটি ও ছাল বেশ পাতলা। ওজন ১৫০-৪৫০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফলের প্রায় ৭৫-৮০ ভাগ খাওয়া যায়। গাছ প্রায় ৫-৬ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। ১৫ ফুট পরপর প্রতি একরে ১০০-১১২টি আমের চারা রোপণ করা যায়। পাঁচ বছর বয়সী প্রতিটি গাছের আম বিক্রি করে গড়ে চার হাজার টাকা পাওয়া যায়।