হার্ডিঞ্জ থেকে পদ্মা সেতু

এই লেখাটি বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী বিজ্ঞানচিন্তার মে, ২০১৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এতে ১০০ বছরে এই ভূখণ্ডে নির্মিত বড় সেতুগুলোর ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। রয়েছে সেতু নির্মাণকৌশলের বাঁকবদলের কথাও। পাঠকের জন্য লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো।

আকবরনামা এখনো প্রাসঙ্গিক। আবুল ফজল ফারসি ভাষায় ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের এই আকরগ্রন্থ লিখেছেন। তিনি মোগল সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) দরবারের ইতিহাস লেখক ছিলেন। বইটির শেষ খণ্ড ‘আইন-ই-আকবরি’র একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে আছে মোগল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক সমীক্ষা। আর তাতে বাংলার নদ-নদীর জটিল গতি-প্রকৃতি ও প্রবাহের বিষয়ে আবুল ফজলের মন্তব্য: বাংলায় প্রবহমান নদ-নদী অসংখ্য। সেগুলো মানুষের জীবনে অনেক প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু এখানকার পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা সাংঘাতিক জটিল; এমনটা বিশ্বের কোথাও মেলে না।

অতীতে এমন পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা দেখে বিদেশি পর্যটকেরা বিস্মিত হয়েছেন। ব্রিটিশ প্রকৌশলী বি এল হার্ভেও একই ধরনের ভাষ্য দিয়েছেন। ১৯৩৩ সালে হার্ডিঞ্জ সেতুর নদীশাসন নিয়ে তিনি বলেছিলেন, গঙ্গা নদী এবং বাংলার পলল সমভূমির সমস্যা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব।

সেতু হচ্ছে একাধিক ভিত্তি অবলম্বনে প্রসারিত একধরনের কাঠামো। খাড়া স্তম্ভের ওপর স্থাপিত হয়ে অনুভূমিক ভার বহন করাই সেতুর কাজ। চিরাচরিত সেতুর গঠন খুবই সরল—দুটি অবলম্বন একটি বিমকে (লম্বা ভারী কাঠামো) ধরে রাখে। তবে প্রতিটি সেতুর প্রকৌশলগত কিছু প্রেক্ষাপট থাকে, সেগুলো সমাধান করেই সেতু নির্মাণ করতে হয়।

যমুনা কিংবা পদ্মার মতো নদীর জটিল গতিপ্রকৃতি ও প্রবাহের মধ্যে সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রকৌশলীরা এখনো সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছেন। অবশ্য সেটার মুখোমুখি হয়েই ব্রিটিশ আমলের প্রকৌশলীরা হার্ডিঞ্জ সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করেন। ১৯১৫ সালে ওই সেতুতে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এটি চালুর শতবর্ষ ছিল ২০১৫ সাল। আর বাংলাদেশ ২০১৪ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে, নিজেদের অর্থায়নে। প্রায় ১০০ বছরের ব্যবধানে এ দুই সেতুর নির্মাণকাজের মধ্যে অমিলই বেশি। পদ্মা সেতু দোতলা, ওপরে আছে সড়ক আর নিচে রেলপথ। কিন্তু হার্ডিঞ্জ সেতুতে কেবল রেলগাড়ি ও পথচারী চলাচলের ব্যবস্থা আছে। সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে পদ্মার জন্য চ্যালেঞ্জও বেশি। কারণ, দেশের যত দক্ষিণের দিকে যাওয়া যায়, নদীর মতি-গতি বোঝাটা তত কঠিন হয়ে পড়ে। নদীশাসনের কাজটাও তাই বড় কঠিন। সেখানে নদীর গতিপথের ভবিষ্যদ্বাণী করাটা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়ায়।

দৈর্ঘ্যের দিক থেকেও হার্ডিঞ্জ ও পদ্মা সেতুর ব্যবধান অনেক। হার্ডিঞ্জ সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার। আর নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু প্রায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার লম্বা। অর্থাৎ এটি হার্ডিঞ্জ সেতুর চেয়ে প্রায় ৩ দশমিক ৪ গুণ দীর্ঘ হবে। অবশ্য এই দুই সেতুরই মূল কাঠামো ইস্পাতের।

পদ্মা সেতুর উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, এই ১০০ বছরের ব্যবধানে দেশে সেতুর নকশা, নির্মাণ ও পদ্ধতিতে এসেছে পরিবর্তন, ছোঁয়া লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির। ভূতত্ত্ব, জলবায়ু, যথাযথ উপকরণের ব্যবহার, স্থানীয় নির্মাণসামগ্রীর গভীর মূল্যায়ন এবং সহজলভ্য প্রযুক্তির দিকটিও প্রাধান্য পেয়েছে।

অবশ্য অতীতে এ অঞ্চলে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ও কৌশলগত কারণে বড় কোনো নদীর ওপর সেতুর নির্মাণের প্রয়াস দেখা যায় না। মোগল আমলের কথাই ধরা যাক। তখন এ অঞ্চলে দীর্ঘ, প্রশস্ত কোনো নদীর ওপর সেতু ছিল না। ছোট ছোট খালের ওপর সেতু তৈরি করা হতো। এমন সেতু নির্মাণে যোগাযোগের চেয়ে প্রতিরক্ষার কাজের গুরুত্ব বেশি থাকত। তবে এখন সেতু নির্মাণের মূল লক্ষ্য থাকে যোগাযোগ বৃদ্ধি।

মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিম খালের ওপর নির্মিত সেতুটি বাংলাদেশে সবচেয়ে পুরোনো সেতুগুলোর একটি, যা এখনো ব্যবহারের উপযোগী অবস্থায় টিকে আছে। সতেরো শতকে মোগল আমলে চুন-সুরকি ও পাথর দিয়ে নির্মিত সেতুটির মধ্যভাগে ধনুকাকৃতির খিলানের মতো স্প্যানের দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৩ মিটার। স্প্যান হলো সেতুর পাশাপাশি যেকোনো দুটি পিলারের মধ্যবর্তী দূরত্ব। সে সময় ছোট খালের ওপর এমন সেতু থাকলেও এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না। এখন কোনো ঘরের জানালা তৈরির সময় ওপরের দিকে একটি বিম (লম্বা চার কোনা লোহা) দেওয়া হয়, যাতে সেটা টান নিতে পারে। আর তা না হলে জানালার ওপর ইটগুলো রাখা সম্ভব হতো না। কিন্তু মোগল আমলে স্থাপনাগুলো পাথর, চুন, সুরকির ওপর ভিত্তি করে তৈরি, লোহার ব্যবহার ছিল না। গম্বুজাকৃতির এসব স্ক্যানে লোহা না থাকলেও ভারসাম্য রক্ষা করে।

হার্ডিঞ্জ সেতু

অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে ১৮৬২ সালে রেলপথ স্থাপনের সময় নদী ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত গবেষণার তাগিদ দেখা দেয়। এমন রেলপথের উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম, কলকাতা, মাদ্রাজ (চেন্নাই), নাগাপাটিনাম, কালিকট, বোম্বে (মুম্বাই) ও করাচির মতো শহরগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা। সেতুর অবস্থান, দৈর্ঘ্য ও সর্বোত্তম স্ক্যান সংখ্যার বিষয়টি নির্ধারণে নদীর স্থান নির্বাচন ছিল জরুরি। সে সময় রেনেলের মানচিত্র (১৭৭৮), আইন-ই-আকবরির (১৫৮২) পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রথমবারের মতো ভূতাত্ত্বিক জরিপ করা হয়, যার মধ্য দিয়ে ১৯১৫ সালে আমরা পেলাম ১ দশমিক ৮ কিলোমিটারের হার্ডিঞ্জ সেতু। এটির স্ক্যানের দৈর্ঘ্য ১০৯ দশমিক ৫ মিটার। সেতুটিতে ইস্পাতের ১৫টি স্ক্যান আছে। বয়স ১০০ পেরোনোর পরও সেতুটি বাংলাদেশের রেল যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।

১৮৮৯ সালে সরকার আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ সহজতর করার লক্ষ্যে পদ্মার ওপর হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। পদ্মার পূর্ব তীর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা এবং অপর পাশে পাবনার পাকশীকে যুক্ত করেছে এই সেতু।

হার্ডিঞ্জ সেতু তৈরির সময় নদীশাসনের কাজটি ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। বন্যার পানির স্তর, নদীর গভীরতা, সেতু এলাকায় ড্রেনেজের জায়গা ও পানির সর্বোচ্চ গতিবেগ এবং নদীর প্রশস্ততাভিত্তিক প্রয়োজনীয় এলাকা পর্যালোচনা করা হয়। অনেক স্থানে নদীর প্লাবনভূমির প্রসারতা কয়েক মাইলজুড়ে হলেও সেতু এলাকায় তা কার্যকরভাবে একটা চ্যানেলে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এই স্থানে চ্যানেলটির বিস্তার দুই পাড়ের মধ্যে ১ দশমিক ৬৪ কিলোমিটারে নিয়ে আসা হয়।

শুরুর ৫ বছর পর ১৯১৪ সালের শেষের দিকে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। ১৯১৫ সালের ১ জানুয়ারি পরীক্ষামূলকভাবে এতে প্রথম মালগাড়ি (ট্রেন) চালানো হয়। ২ মাস পর ৪ মার্চ ডাবল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। সেদিন সেতুটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। তাঁর নামানুসারেই সেতুটির নামকরণ।
অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের আরও কয়েকটি সেতুর কথা উল্লেখ করা যায়। যেমন ৯১ দশমিক ৫ মিটারের স্ক্যান দিয়ে নির্মিত ৬৪০ মিটার ভৈরব সেতু, ৬৫০ মিটার দীর্ঘ তিস্তা সেতু (স্ক্যান ৫০ মিটার) এবং ৫৩৫ মিটার দীর্ঘ কালুরঘাট সেতু (স্ক্যান ৫৫ মিটার)।

হার্ডিঞ্জ ও তিস্তা দার্জিলিংয়ের সঙ্গে কলকাতাকে সংযুক্ত করে। ভৈরব ও কালুরঘাট সেতু আসামের সবচেয়ে দূরবর্তী অংশের সঙ্গে সংযোগ ঘটায় চট্টগ্রামের। গড়াই সেতুটিও এই সময়ে তৈরি, যার দৈর্ঘ্য ৫১৫ মিটার, স্ক্যান ৫৬ মিটার। কালুরঘাট সেতুটি পরে রেল সড়কে রূপান্তর করা হয়। একই পরিবর্তন দেখা যায় তিস্তা সেতুতে।
এই সময়ে সেতুগুলোর বেশির ভাগই ছোট নদী-উপনদীর ওপর নির্মিত। ছোট স্ক্যানের এসব সেতুর দৈর্ঘ্যও ছিল কম।

১৮৮৯ সালে সরকার আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ সহজতর করার লক্ষ্যে পদ্মার ওপর হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রায় এক দশকের মধ্যে জাপানি কারিগরি সহযোগিতায় ২৫ মিটার স্ক্যানের বেশ কিছু সেতু নির্মাণ করা হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতবর্ষ আলাদা হওয়ার পর নির্মিত এমন সেতুর প্রায় সব কটির পাশে এক লেনের সুরক্ষিত হাঁটার পথ ছিল। পরবর্তী সময়ে পুরোপুরি স্থানীয় প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শুরু হয় সেতু নির্মাণ। এমন সেতুর নকশা ও দেখভালের দায়িত্ব পান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমানে বুয়েট) অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত। ১৯৬২ সালের মধ্যে দেশীয় ঠিকাদার দিয়ে ধলেশ্বরীর ওপর তৈরি হয় জায়গির সেতু। ৪৯৩ মিটার দীর্ঘ এ সেতুকে বলা যায় এ অঞ্চলে প্রথম বক্স গার্ডার সেতু। সেতুটির মূল স্ক্যানের দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৪ মিটার।

১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহযোগিতায় তরা, আমিনবাজার ও নয়ারহাটে কয়েকটি সেতু নির্মাণ করা হয়। এসব নির্মাণকাজের মধ্য দিয়ে প্রিস্ট্রেসড কংক্রিট প্রযুক্তির সূচনা হয়। স্ক্যান তোলার কাজে ব্যবহৃত হতো ভাসমান বার্জ। ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে দেশীয় ঠিকাদার বড়াল নদের বাঘাবাড়িতে পিসি গার্ডারের সেতু নির্মাণে সমর্থ হন।

পদ্মার মাওয়া ঘাটের প্রান্তে নির্দিষ্ট দূরত্বে অন্তত চার-পাঁচটা স্থানে নদীর বুকে বসানো হয়েছে বিশাল ক্রেন

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। যুদ্ধের সময় প্রায় ২৭৬টি সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে হার্ডিঞ্জ সেতু, ভৈরব রেলসেতু, সিলেটের কিন সেতু। এগুলো মেরামতের পাশাপাশি স্থায়ী যোগাযোগ বাড়াতে আরও সেতু, সড়ক তৈরির ওপর সরকার জোর দিয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আর্থিক সংকটও ছিল। এ ক্ষেত্রে সেতু তৈরিতে দেশীয় উপকরণ ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের ওপর প্রকৌশলীদের নির্ভর করতে হতো। সেতু নির্মাণে প্রায়ই যুক্ত হতেন দেশীয় ঠিকাদারেরা।

সে সময় দেশের বিভিন্ন নদী-উপনদীর মধ্যে সংযোগ গড়তে বেশ কিছু নকশায় আরসি সেতু, পিসি আই-গার্ডার সেতু এবং কয়েকটি বড় খিলানের সেতু বানিয়ে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানো হয়েছে। তুলনামূলক বড় সেতুগুলো নির্মাণে বিদেশি সংস্থা ও বন্ধুপ্রতিম দেশ সাহায্য করেছে। এসব প্রকল্পে আন্তর্জাতিক পরামর্শক ও ঠিকাদারেরা দেশের প্রকৌশলী ও দেশীয় ছোট ঠিকাদারদের সঙ্গে কাজ করেন। এভাবে সেতু নির্মাণের নকশা ও প্রযুক্তিতে একধরনের নীরব পরিবর্তন ঘটেছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও নির্মাণের কলাকৌশল আমরা আয়ত্ত করতে থাকি। মেঘনা সেতু, দপদপিয়া সেতু, খানজাহান আলী সেতু, সুলতানা কামাল সেতু প্রভৃতি স্থাপনা উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু নির্মাণের সময় হুন্দাই নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি সিমেন্ট উৎপাদন কারখানা খুলেছিল। এতে বাংলাদেশে সিমেন্ট উৎপাদনের বহুমুখিতার একটি নতুন ধাপের সূচনা হয়।

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় গত ১৪০ বছরের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি সেতুর দৈর্ঘ্য, মূল স্প্যানের দৈর্ঘ্য, সেতুর উপরিকাঠামোতে দীর্ঘতম স্প্যান তৈরিতে ব্যবহূত উপকরণ ও সেতু নির্মাণে ভিত্তির বিশ্লেষণে এ অঞ্চলে সেতুর প্রকৌশল ইতিহাসে বাঁকবদলের একটা চিত্র মেলে

বঙ্গবন্ধু সেতু

বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুর দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮ দশমিক ৫ মিটার। ১৯৯৮ সালের জুন মাসে এটি উদ্বোধন করা হয়। যমুনার ওপর নির্মিত সেতুটি পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে। একসময় সড়কপথে ও নৌ ফেরির মাধ্যমে ঢাকা থেকে বগুড়া যেতে যেখানে ১২ ঘণ্টা সময় লাগত, সেখানে এই সেতুর ওপর দিয়ে সময় লাগে মাত্র ছয় ঘণ্টা।

সম্ভাব্য দুর্যোগ ও ভূমিকম্প মোকাবিলায় ৮০ থেকে ৮৫ মিটার লম্বা এবং ২ দশমিক ৫ ও ৩ দশমিক ১৫ মিটার ব্যাসের ১২১টি ইস্পাতের খুঁটির ওপর সেতুটি নির্মিত। খুঁটিগুলো খুবই শক্তিশালী (২৪০ টন) হাইড্রোলিক হাতুড়ি দিয়ে বসানো। সেতুটিতে স্ক্যানের সংখ্যা ৪৯ এবং ডেক খণ্ডের সংখ্যা ১ হাজার ২৬৩। সেতুটির ওপর দিয়ে চার লেনের সড়ক এবং রেলট্র্যাক বসানো হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঞ্চালন এবং টেলিযোগাযোগ লাইন। সেতুটির উপরি কাঠামো ঢালাই করা খণ্ডাংশ দিয়ে তৈরি এবং এগুলো সুস্থিত খিলান পদ্ধতিতে বসানো হয়েছে।

লালন শাহ সেতু

ঈশ্বরদীর হার্ডিঞ্জ সেতুর অদূরে পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮ দশমিক ১০ মিটার। এই সেতুতে প্রি-কাস্ট সেগমেন্টাল পিসি বক্স কৌশল ব্যবহার করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ইস্পাত ও কংক্রিটের বড় বড় খণ্ড আগেই ঢালাই করে বিশেষ পদ্ধতিতে যুক্ত করে সেতু তৈরি করা হয়। হার্ডিঞ্জ সেতু স্টিলের হলেও লালন শাহ সেতু কংক্রিটের। দুই সেতুর মধ্যে দূরত্ব প্রায় ২৮০ মিটার। নির্মাণকালের ব্যবধান প্রায় ৮৯ বছর।

পদ্মা বহুমুখী সেতু

পদ্মা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রমত্তা নদীগুলোর একটি। পদ্মা সেতু যেখানে নির্মিত হচ্ছে, সেখানে নদী প্রায় ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত। এটি বাস্তবায়িত হলে খুলনা, বরিশালসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ কমে আসবে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। যানবাহনের গতি থাকবে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার।

বর্ষাকালে পদ্মা নদীতে স্রোতের বেগ এত বেশি থাকে যে সেতুর নকশা করার সময় প্রকৌশলীদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই তা বেশ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ এশিয়ার দুটি বিশাল এবং দীর্ঘ নদ-নদীর অববাহিকার পানি এই পদ্মা দিয়েই বঙ্গোপসাগরে নামছে। উজান থেকে নেমে আসা এই স্রোতের ধাক্কা সামলাতে হবে পদ্মা সেতুকে। ১৯৯০ সালের দিকে অস্ট্রেলিয়ায় সেতুতে সুপার টি গার্ডার (ইস্পাতের কাঠামোর ওপর সেতুর স্তম্ভ) বিমের উন্নত রূপ দেখা যায়। এর আগে প্রি-কাস্ট আই গার্ডার ছিল সেতুতে মধ্যম মানের স্ক্যান তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উপকরণের একটি। প্রি-কাস্ট হলো আগেই ছাঁচে-ঢালাই করে কাঠামোটা তৈরি করার উপায়। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পদ্মা সেতুতে সুপার টি গার্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে নির্মাণশিল্প পোস্ট টেনশন পদ্ধতিতে গার্ডার তৈরিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও এই প্রকল্পে সুপার টি গার্ডারের ব্যবহার ভবিষ্যতে প্রি-কাস্ট বিম প্রযুক্তির সূচনা করবে।

নির্মাণকৌশলে বাঁকবদল

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় ১৪০ বছরের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি সেতুর দৈর্ঘ্য, মূল স্ক্যানের দৈর্ঘ্য, সেতুর উপরি কাঠামোতে দীর্ঘতম স্ক্যান তৈরিতে ব্যবহৃত উপকরণ ও সেতু নির্মাণে ভিত্তির বিশ্লেষণে এ অঞ্চলে সেতুর প্রকৌশল ইতিহাসে বাঁকবদলের একটা চিত্র মেলে। ১৮৭০ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত নয়টি সেতুর ভিত্তি তৈরিতে ক্যাশন পদ্ধতির ব্যবহার ছিল। এ সময়ের মধ্যে কেবল তিনটি সেতুর ভিত্তি স্টিল পাইল। ক্যাশন পাইল বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় ছিল। স্থানীয় প্রযুক্তিতে এমন ভিত্তি তৈরি করা যেত। এ পদ্ধতিতে নদীর তলে পানিপ্রতিরোধী কূপ আকৃতির অবকাঠামো তৈরি করা হয়। এমন কূপ পরে কংক্রিট দিয়ে ভরা হয়। আর পাইলিং হলো বর্তমানে ভিত্তি তৈরির একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। পাইল সাধারণত কংক্রিট বা ইস্পাতের তৈরি। সেতুর ভিত্তি বা পাইলিং কত গভীর হবে, তা নির্ভর করে নদীর ভূতত্ত্বের ওপর। ক্যাশন ভিত্তিতে তৈরি সেতুগুলোর মধ্যে আছে হার্ডিঞ্জ, তিস্তা ও ভৈরব রেলসেতু। এসব সেতুর উপরি কাঠামো স্টিলের তৈরি। আমিনবাজার, কাঁচপুর, বাঘাবাড়ির বড়াল সেতু ক্যাশন ভিত্তিতে তৈরি হলেও উপরি কাঠামোতে প্রিস্ট্রেসড কংক্রিটের গার্ডার ব্যবহার হয়েছে।

আশির দশকের পর সেতুর ভিত্তি তৈরির ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন আসে। সে সময় থেকে বেশির ভাগ সেতুতে বোরড পাইল ব্যবহার করা হচ্ছে। নদীর তলদেশে স্কাউরিং (বালু সরে যাওয়া) ও প্রবল স্রোত সত্ত্বেও কারিগরি সামর্থ্যের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বোরড পাইল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে সেতু নির্মাণে ক্যাশন পাইলের পরিবর্তে বড় মাপের ব্যাসের বোরড পাইল জায়গা করে নিচ্ছে। বোরড পাইলিংয়ে মাটির নির্দিষ্ট গভীরতা পর্যন্ত একটা ছিদ্র করা হয়। এই ছিদ্রের মধ্যে লোহার খাঁচা নামানো হয়। এরপর পুরো ছিদ্রটা কংক্রিট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেতুর ভার বহন করতে পারে এমন গভীরতায় মাটির স্তর পর্যন্ত ছিদ্রটা করা হয়। মাটির ভার বহন ও নদীর স্কাউরিং গভীরতার ওপর নির্ভর করে পাইলের দৈর্ঘ্য। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে নদীর স্কাউরিং কতটা হতে পারে, সেই হিসাবটাও বিবেচনায় রাখা হয়। যেমন কোনো নদীর স্কাউরিং গভীরতা বেশি হলে ছিদ্রের দৈর্ঘ্যও বাড়ে। আর তা না করলে সেতু ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।

তৎকালীন ইস্টার্ন বেঙ্গল রেল কোম্পানির (বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ে) সঙ্গে যুক্ত ছিল যুক্তরাজ্যের প্রকৌশলী জেমস মিডোস রেনডেলের নামে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্রিটিশ প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান রেনডেল। প্রতিষ্ঠানটি হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণে যুক্ত ছিল। ১৮৫২ সালের ১৩ জানুয়ারি রেনডেল লন্ডনে পুরকৌশলীদের সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেছিলেন, পুরকৌশলের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, কোনো কাজ ভুল-শুদ্ধ যা-ই হোক, কেবল কারিগরি দক্ষতার ওপর নির্ভর করে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে না। প্রতিটি পদক্ষেপ চূড়ান্ত প্রভাবের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে। এ বিবেচনা হবে সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির। কেবল তাৎক্ষণিক প্রভাব নয়, ভবিষ্যৎ সমাজের ওপর তার সামগ্রিক প্রভাবের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা উচিত।

সেতু প্রকৌশল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং আইএবিএসই, বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম সাইফুল আমিন। তাঁর মতে, প্রকৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, যা প্রকৃতির জন্য একধরনের উপশম হিসেবে কাজ করে। এর ফলে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির পর প্রকৃতি সেরে ওঠে এবং পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। কোনো সেতু নির্মাণেও এমন চিন্তা বিবেচনায় রেখে প্রকৌশলীরা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চান। এর ফলে জ্বালানি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কম পড়ে। পরিকাঠামো টেকসই হয়। পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমে যায়। প্রকৌশলগত সমাধানে পৌঁছার জন্য প্রকৃতি এবং সমাজ সম্পর্কে ধারণাকে গাণিতিক সূত্রে পরিবর্তিত করেন বিজ্ঞানীরা। এভাবে স্বপ্নের প্রকল্পগুলো বাস্তবে রূপ দিতে সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যকার সাদৃশ্যগুলোকে কাজে লাগান প্রকৌশলীরা।

সূত্র:

1. Advances in Bridge Engineering-I, AFM Saiful Amin, Yoshiaki Okui, AMM Safiullah, (editors) 2005.
2. Advances in Bridge Engineering-I I, AFM Saiful Amin, Yoshiaki Okui, Abdur Rahman Bhuiyan (editors) 2010
3. Advances in Bridge Engineering-I I I, AFM Saiful Amin, Yoshiaki Okui, Abdur Rahman Bhuiyan, Tamon Ueda (Editors) 2015. 4. বাংলা পিডিয়া 5. Britannica Online Encyclopedia