হার্নিয়ার অস্ত্রোপচার খরচে আকাশ-পাতাল ফারাক
>• স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়।
• বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এই ব্যয় সরকারিগুলোর ১০-১০০ গুণ বেশি।
সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে শিশুদের অস্ত্রোপচারের খরচ অনেক বেশি। হার্নিয়াসহ অন্যান্য অস্ত্রোপচারের খরচ বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা দেখেছেন, এই পার্থক্য ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশি।
আবার সরকারি হাসপাতালের মধ্যেও একই চিকিৎসায় খরচের তারতম্য দেখা গেছে। অথচ সঠিক নীতি অনুসরণ করলে কম খরচেই সাধারণ মানুষকে মানসম্মত অস্ত্রোপচার সেবা দেওয়া সম্ভব।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৩২১ জন শিশুর অস্ত্রোপচারের খরচের তথ্য বিশ্লেষণ করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের শিশু অস্ত্রোপচার বিভাগ ও চিটাগং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর চিলড্রেন সার্জারির গবেষক ও চিকিৎসকেরা এই তথ্য দিয়েছেন। তাঁদের এই বিশ্লেষণ প্রবন্ধ আকারে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড জার্নাল অব সার্জারিতে ছাপা হয়েছে। গবেষকেরা দাবি করেছেন, অস্ত্রোপচারের আর্থিক দিক নিয়ে দেশে তথ্য কম আছে। তাই এই গবেষণার তথ্য নীতিনির্ধারকদের কাজে লাগবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা যদি উপজেলা হাসপাতালে হার্নিয়া অস্ত্রোপচার করেন, তবে খরচ হয় মাত্র ৪০০ টাকা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হার্নিয়ার অস্ত্রোপচারে গড়ে ৪ হাজার ৭২০ টাকা খরচ হয়। একই অস্ত্রোপচার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ‘ডে-কেয়ার সেটিংস’-এ করলে খরচ হয় ২ হাজার ৩২০ টাকা।
এই একই অস্ত্রোপচার চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে করলে খরচ পড়ে গড়ে ৪০ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম শহরের বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করলে খরচ হয় ১২-১৩ হাজার টাকা।
এই গবেষণা দলের নেতৃত্বে ছিলেন চিটাগং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর চিলড্রেন সার্জারির চেয়ারপারসন অধ্যাপক তাহমিনা বানু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে একটি পরিবার শিশুর জন্য কত খরচ করে, তার সঠিক হিসাব বের করা ছিল এই গবেষণার উদ্দেশ্য। দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৬৭ শতাংশ, যা অনেক বেশি।’
গবেষণাকে গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক। তিনি স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ন ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে গবেষণা করছেন। রুমানা হক প্রথম আলোকে বলেন, একই অস্ত্রোপচারের মূল্যের অতটা পার্থক্য থাকা উচিত নয়। সরকারের এখানে মূল্য নির্ধারণের সুযোগ আছে। তবে সরকারি হাসপাতালে অল্প খরচে করতে গিয়ে মান নিয়ে যেন প্রশ্ন না ওঠে, তা-ও দেখতে হবে।
এই ৩২১ জন শিশুর অস্ত্রোপচার হয়েছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে, একই বিভাগের ডে-কেয়ার সেটিংস শাখায়, চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রে একটি বেসরকারি হাসপাতাল এবং রাঙামাটির বরকল উপজেলার একটি বেসরকারি অলাভজনক হাসপাতালে। এদের বয়স ছিল ২৮ দিন থেকে ১৯ বছর। এদের বিভিন্ন রোগের জন্য অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। এর মধ্যে ১৪৩ জনের হয়েছিল হার্নিয়ার অস্ত্রোপচার।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো সরকারি তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে কোনো খরচ হয় না। তবে ওষুধসহ কিছু সরঞ্জামের জন্য খরচ করতে হয়। এ ছাড়া রোগী ও আত্মীয়ের খাওয়া, যাতায়াত ও শহরের থাকার জন্য খরচ আছে।
এই হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের ডে-কেয়ার সেটিংস শাখায় খরচ এর প্রায় অর্ধেক। এখানে দিনে এসে অস্ত্রোপচার শেষে রোগী দিনেই ফিরতে পারেন। ফলে থাকা ও বাড়তি খাওয়ার খরচ হয় না।
চলতি বছরের জুন মাসে প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকের বয়স (৪৯.৫ শতাংশ) ১৯ বছরের কম। দেশের শিশুদের অস্ত্রোপচারের চিকিৎসা অবকাঠামো প্রধানত বড় বড় শহরে অবস্থিত। গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলো শিশুদের অস্ত্রোপচার সেবা থেকে অনেকাংশেই বঞ্চিত।