হায়দারাবাদের গোলকান্ডা দুর্গ ভ্রমণ

হায়দারাবাদের গোলকান্ডা দুর্গ ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য অন্যতম এক জায়গা। ছবি: সংগৃহীত
হায়দারাবাদের গোলকান্ডা দুর্গ ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য অন্যতম এক জায়গা। ছবি: সংগৃহীত

আমার গল্পটা একটু অন্যরকম। গোলকান্ডা দুর্গ নিয়ে নির্মিত একটা ডকুমেন্টারি দেখে আমি আর ভ্রমণ পিপাসু জীবনসঙ্গী সিদ্ধান্ত নিলাম হায়দারাবাদ যাব। সময়টা ছিল শীতকাল। খুব বেশি পরিকল্পনা না করেই রওনা হয়ে গেলাম দিল্লির উদ্দেশ্যে। এরপর দিল্লি থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে চেপে পুরো একদিন পর পৌঁছলাম ‘সিটি অব পার্লস’ নামে পরিচিত ছিমছাম ছোট্ট শহর হায়দারাবাদে। শহরটি স্রোতস্বিনী নদী মুসির তীরে অবস্থিত দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গনা রাজ্যর রাজধানী। মুঘল সাম্রাজ্যর পূর্বেই ১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে কুতুব শাহী রাজ বংশের পঞ্চম শাসক মুহম্মদ কুলি কুতুব শাহের হাতে ইতিহাস বিখ্যাত এই শহরটির গোড়াপত্তন।

খুব সকালে ট্রেন থেকে নেমেই আগে থেকে রিজার্ভ করা হোটেলে উঠলাম। হোটেল থেকে বেরিয়ে কিছু দূর গেলেই বিখ্যাত চার মিনার যাকে কেন্দ্র করে হায়দারাবাদ শহরটি ছড়িয়ে। চার মিনার ভারতের তালিকাভুক্ত সর্ব স্বীকৃত একটি স্থাপনা, যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাজারো দোকানপাট, সারি সারি রেস্তোরাঁ আর ক্যাফে। একটা রেস্তোরাঁ বেছে নিয়ে বসে পড়লাম দুজনে। জবরদস্ত খিদে পেয়েছিল। আজ মনে হয় সেদিন হায়দারাবাদী বিরিয়ানি না চাখলে বুঝি পস্তাতে হতো!

হায়দারাবাদের গোলকান্ডা দুর্গে ভ্রমণ পিপাসুদের ভিড়। ছবি: সংগৃহীত
হায়দারাবাদের গোলকান্ডা দুর্গে ভ্রমণ পিপাসুদের ভিড়। ছবি: সংগৃহীত

পরদিন খুব ভোরে রওনা হলাম আমাদের প্রধান লক্ষ্যে গোলকুন্ডা দুর্গের পথে। দুর্গটি হায়দারাবাদের পশ্চিমে ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারতবর্ষের সুন্দর দুর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রাপথে বেশ কয়েকটি পরিত্যক্ত হিরার খনি চোখে পড়ল। গাড়িচালকের কাছে জানতে পারলাম বিখ্যাত দরিয়া-ই-নূর আর কোহিনূর হিরার সন্ধান মিলেছিল এ অঞ্চলে। যা হোক দুর্গে পৌঁছানোর পর অন্যরকম এক ভালো লাগায় আবিষ্ট হয়েছিলাম। শত শত বছরের ইতিহাস বুকে লালন করে আছে এ দুর্গ। ভালোবাসা, ধ্বংস, ক্ষয় আর বৈরী প্রকৃতির মাঝে থেকেও যা অবশিষ্ট আছে তা হলো অকৃত্রিম স্থাপত্য শৈলী। শাহি শাসনামলের ঐতিহ্য আর প্রকৃতির রহস্যময়তায় আবৃত এক অনাবিল সৌন্দর্য। দুর্গে ঢুকেই একদম খাঁড়া একটা রাস্তা। মাথা তুলে তাকাতেও কিছু ঠাওর হয় না। ভয়ে ভয়ে বরের দিকে তাকালাম, বেচারার অবস্থাও নাজেহাল। পিঠে ভারী ব্যাগ, গলায় ডিএসএলআর কামেরা! সাহায্যের ভাবনা ভুলে তাই পা বাড়ালাম। দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে এভারেস্ট জয়ের চেয়ে কম আনন্দ পাইনি সেদিন!

রাতের আলোয় হায়দারাবাদের চার মিনার। ছবি: নাফিসা আবেদীন কথা
রাতের আলোয় হায়দারাবাদের চার মিনার। ছবি: নাফিসা আবেদীন কথা

পুরো হায়দারাবাদ শহরটি দেখা যায় দুর্গ থেকে। দুর্গের স্থাপত্য কলার উল্লেখযোগ্য একটি হলো ফতেহ দরওয়াজা বা বিজয় তোরণ। এ বিজয় তোরণ দিয়েই আওরঙ্গজেব বিজয়ীর বেশে দুর্গে প্রবেশ করেছিলেন বলে এর নাম বিজয় তোরণ। প্রবেশের জন্য মোট আটটি তোরণের মধ্যে এই তোরণটি উঁচু খিলানওয়ালা লোহার শলাকা দিয়ে তৈরি। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, এ দুর্গ দখলের জন্য আওরঙ্গজেবকে নয় মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল দুর্গ-প্রাচীরের বাইরে। এক বিশ্বাসঘাতকের মাধ্যমে তিনি এই দুর্গ দখল করতে পেরেছিলেন। শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে এর নির্মাণশৈলীতেও রয়েছে অত্যন্ত চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক কৌশলের ব্যবহার। গোলাকুন্ডা দুর্গটির উঁচু খিলানওয়ালা ফতেহ দরওয়াজা দিয়ে প্রবেশ করেই খিলানের নিচে একটি বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে তালি বাজালে দুর্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় ১ কিলোমিটার ওপরে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিও তা স্পষ্ট শুনতে পান। এ তালির আওয়াজ, তোরণের আশপাশের কোনোও স্থাপনা থেকে শোনা যায় না। এর উদ্দেশ্য ছিল দুর্গের ফটকে কোনো আগন্তুকের আগমনের বার্তা সঙ্গে সঙ্গে ওপরে থাকা রাজকীয় ব্যক্তিবর্গের কানে পৌঁছে দেওয়া। ফোর জি আর ইন্টারনেটের এই যুগেও তালি বাজানো এই প্রক্রিয়াটি পর্যটকদের ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। আমরা সারাটা দিন কাটিয়ে দিলাম বিশাল বিস্তৃত দুর্গের ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা দর্শনে-যার মধ্যে ছিল বালাহিসার, সুলতানি নির্মাণশৈলীতে নির্মিত বাগান নাগিনা বাগ, অন্দরমহলের মাঝে ছাদ-বাগান আর বিশাল আকৃতির রাজদরবার। গোধূলি লগ্নে দুর্গে অন্ধকার করিডর, ফাঁকা বিস্তৃত স্থান বড় বড় জানালা আর ভুতুড়ে পরিবেশে দুজনে অপেক্ষা করতে লাগলাম লাইট আর সাউন্ড শো উপভোগের লোভে। মুহূর্তের মাঝে আলোকসজ্জা ও শব্দে মূর্ত হয়ে উঠল গোলকান্ডার অজানা নানা কাহিনি। সেই সঙ্গে মোহাম্মাদ কুলি কুতুব শাহ এবং নর্তকী ভাগ্মতীর এক ব্যর্থ প্রেমের উপাখ্যানও। জগৎ বিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের ভরাট কণ্ঠে মূর্ত হয়ে উঠল সুলতানি আমলের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস। ভাবতেই বড় অবাক লাগে যে দুর্গ আজ হতে শত শত বছর আগে কোহিনূর হিরাকে আপন বুকে লুকিয়ে রাখত লোকচক্ষুর অন্তরালে, আজ তা শুধুই ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী।

এবারে ফেরার পালা। রাতের আকাশে সেদিন ছিল হাজারো তারার মেলা, পেছনে রাজকীয় ইতিহাসের সাক্ষী পৃথিবীর সুন্দরতম বড় দুর্গগুলোর একটি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি মনের অজান্তে গুন গুন করে গাইতে লাগলাম ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে, মহাকাল মাঝে, আমি মানব একাকী, ভ্রমি বিস্ময়ে।

*নাফিসা আবেদীন কথা: চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়