হৃদ্‌রোগ চিকিৎসায় দেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ

চিকিৎসকেরা হৃদ্‌রোগ চিকিৎসায় দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন। সমস্যা যা আছে, তা মূলত নীতির, পরিকল্পনার ও ব্যবস্থাপনার।

বাংলাদেশ এখন হৃদ্‌রোগ চিকিৎসায় প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ হৃদরোগের চিকিৎসার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। এর জন্য দক্ষ জনবল, আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি দেশেই আছে। তিনটি ব্যতিক্রম ছাড়া হৃদ্‌রোগ চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার দরকার নেই।

হৃদ্‌রোগকে অনেকে বলেন ‘ডেডলি ডিজিজ’। এ রোগে মৃত্যুঝুঁকি থাকে, কিছু ক্ষেত্রে এই মৃত্যুঝুঁকি আচমকাই দেখা দেয়। কোনো সূত্র ছাড়াই হঠাৎই ‘হার্ট অ্যাটাক’–এর খবর আসে। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। ঘটনার এই আকস্মিকতা ছাড়াও হৃদ্‌রোগ নিয়ে ভয়ের আরেকটি কারণ এর চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি।

একসময় হৃদ্‌রোগ চিকিৎসার জন্যও অনেকে দেশের বাইরে যেতেন। তবে এখন তা কমে এসেছে। দেশেই আন্তর্জাতিক মানের হৃদ্‌রোগ চিকিৎসক ও চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। হয়তো তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।

হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ ও কার্ডিয়াক সার্জনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হৃদ্‌রোগ চিকিৎসার তিনটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে বা সক্ষমতা তৈরি হয়নি। কার্ডিয়াক ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা হৃদ্‌যন্ত্র প্রতিস্থাপন বাংলাদেশে এখনো শুরু হয়নি। জন্মগত কিছু জটিল হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা এখনো দেশের চিকিৎসকদের আয়ত্তে আসেনি। এ ছাড়া মাংসপেশির দুর্বলতাজনিত হৃস্‌রোগের চিকিৎসা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দিতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। বাকি সব চিকিৎসা দেশে রয়েছে।

হৃদ্‌রোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ বলা যায় প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ দেশে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষের চাহিদার তুলনায় চিকিৎসার এই সুযোগ খুবই কম।
আবদুল মালেক, হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ

জটিল ও জরুরি এই চিকিৎসায় দেশ কী করে এগিয়ে গেল, এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থোরাসিক সার্জনস অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক অসিত বরণ অধিকারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘একদল প্রতিভাবান ও নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক বিদেশে থেকে দিন–রাত পরিশ্রম করে বিশেষায়িত চিকিৎসা আয়ত্ত করেছেন, দক্ষতা অর্জন করেছেন এবং অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেশের কাজে লাগিয়েছেন। তাঁদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হাত মিলিয়েছে বলেই হৃদ্‌রোগ চিকিৎসায় দেশ এতটা অগ্রসর হতে পেরেছে।’

স্বাধীনতার ১০ বছর পর

অনেকের হৃৎপিণ্ডে জন্মগত ত্রুটি থাকে, ওষুধে ভালো হয় না। অনেকের হৃৎপিণ্ডের রক্তনালি বন্ধ হয়ে যায়। এসব জটিলতায় ওপেন হার্ট সার্জারি একমাত্র ভরসা। এর শুরুটা হয়েছিল এখন থেকে ৪০ বছর আগে।

অধ্যাপক নবী আলম খানের নেতৃত্বে ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে দেশে প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া কলেজের একজন শিক্ষার্থী ছিলেন রোগী। ওই সফল অস্ত্রোপচারে অংশ নেওয়া চিকিৎসক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন অধ্যাপক এস আর খান।

দেশের প্রথম ও সফল ওপেন হার্ট সার্জারি সম্পর্কে অধ্যাপক এস আর খান ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘টিম ওয়ার্ক ছাড়া ওপেন হার্ট সার্জারি করা সম্ভব নয়। দলের প্রতিটি সদস্য হবেন সাহসী, যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও দক্ষ। এই দলে থাকবেন কার্ডিয়াক সার্জন, অবেদনবিদ, কার্ডিয়াক সার্জনদের সহকারী, যন্ত্রবিদ (সার্জিক্যাল টেকনোলজিস্ট), নার্স এবং পারফিউশনিস্ট।’

প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি সফল হওয়ায় এই বিশেষায়িত চিকিৎসার ব্যাপারে মানুষের আস্থা বাড়ে, তরুণ অনেক চিকিৎসক এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা উৎসাহী হয়ে ওঠে। হৃদ্‌রোগ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হৃদ্‌রোগ চিকিৎসা সহজলভ্য করার কাজে ব্রতী হয় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশে এ পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি মানুষের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। সরকারি–বেসরকারি ২২টি হাসপাতালে বর্তমানে ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। এসব হাসপাতালে প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ হাজার বাইবাস সার্জারি হয়। ১৫–১৬ হাজার এনজিওপ্লাস্টি হয়। ৫০ হাজারের বেশি এনজিওগ্রাম হয়। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এসব বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রায় সবটুকু সুযোগ রাজধানীকেন্দ্রিক। সমস্যাটি মূলত সরকারি নীতি ও পরিকল্পনার।

একই সঙ্গে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ বেড়েছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ইনস্টিটিউটটি এখন পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান। নাম জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, বিএসএমএমইউ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে উচ্চতর ডিগ্রির পাশাপাশি নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রশিক্ষণের জন্য বা হাতে–কলমে শেখার জন্য বহু চিকিৎসক নিয়মিত দেশের বাইরে যাচ্ছেন। দক্ষতা অর্জনই মূল লক্ষ্য। ইউনাইটেড হাসপাতালের চিফ কার্ডিয়াক সার্জন ডা. জাহাঙ্গির কবির এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘হার্ট সার্জারি হচ্ছে একটা ফাইন আর্ট। দুই মিলিমিটার বেড়ের একটি রক্তনালিকে আরেকটি দুই মিলিমিটারের নালির সঙ্গে জুড়তে গিয়ে ১৬ থেকে ১৮টি সেলাই দিতে হয়। এটা সহজ কাজ নয়। বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। একজন ভালো গায়ক হতে হলে যেমন কয়েক বছর রেওয়াজ করতে হয়।’

এখন দরকার সচেতনতা

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ডায়াবেটিস, কিডনির জটিলতা, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার, হৃদ্‌রোগের মতো অসংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। যে হারে মানুষ হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, চিকিৎসার প্রসার সেই তুলনায় বাড়ছে না। বহু মানুষ চিকিৎসার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

বিশিষ্ট হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘হৃদ্‌রোগ চিকিৎসায় বাংলাদেশ বলা যায় প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ দেশে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষের চাহিদার তুলনায় চিকিৎসার এই সুযোগ খুবই কম।’

এ ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে তোলা বিশেষ দরকার। প্রথমত, হৃদ্‌রোগ যেন না হয়, সে ব্যাপারের মানুষকে সচেতন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া দরকার যে দেশেই প্রায় সব ধরনের হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা আছে। তৃতীয়ত, সরকারি উদ্যোগে জেলা বা বিভাগীয় শহরে হৃদ্‌রোগ চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তোলা, যেন মানুষকে জরুরি প্রয়োজনে ঢাকায় আসতে না হয়।