১০০ বছরের কথা মাথায় রেখে পদ্মা সেতু নির্মাণ

২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এই সেতু নির্মাণ ও তদারকিতে যুক্ত এবং সুবিধাভোগী জেলার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। আজ ছাপা হলো পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদের সাক্ষাৎকার

পদ্মা সেতুর পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার (ইআইএ) দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম ফিরোজ আহমেদ। এই সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে পরিবেশ সুরক্ষায় নেওয়া নানা পদক্ষেপ নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

এম ফিরোজ আহমেদ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পদ্মা সেতু এলাকার পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টিকে কীভাবে দেখেছেন?

ফিরোজ আহমেদ: যেকোনো বড় প্রকল্প করতে গেলে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হয়। ইআইএর মাধ্যমে পরিবেশের সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিকগুলো চিহ্নিত করে সেসব রোধে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে আমার মূল দায়িত্ব ছিল পদ্মা সেতু এলাকার পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’। সম্প্রতি জাজিরা প্রান্তে।
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

প্রশ্ন :

পদ্মায় ইলিশের প্রজনন ও বিস্তারে সেতু নির্মাণের কোনো প্রভাব পড়বে?

ফিরোজ আহমেদ: পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরু থেকেই ইলিশের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনেক গণমাধ্যমে বলা হলো, এর মাধ্যমে ইলিশের বিচরণ এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পদ্মার চরগুলোতে একটি বিশেষ ধরনের কচ্ছপ আছে, যারা সেখানে ডিম পাড়ে। নদী খননকালে কাদার সঙ্গে পলিথিনসহ অনেক ক্ষতিকর পদার্থ উঠতে পারে। নদীর তলদেশে সেতুর পিলার বসানোর সময় অনেক শক্তিশালী হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হয়, যা থেকে অনেক শব্দ হয়। সেতু নির্মাণকালে আমাদের এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

এতগুলো চ্যালেঞ্জ আপনারা কীভাবে মোকাবিলা করলেন?

ফিরোজ আহমেদ: আমরা বেশ কয়েকটি পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম। সেতু নির্মাণের সময় বেশ কিছু জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য একটি পুনর্বাসন পরিকল্পনা করতে হয়েছে। নদীর যেসব স্থানে সাত মিটারের বেশি গভীরতা, সেখানে কোনো পিলার বসানো হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়, যাতে সেখানে ইলিশ ডিম পাড়তে ও বিচরণ করতে পারে। নির্মাণকাজ চলাকালে পুরোটা সময় আমরা এসব তদারকি করেছি। আমরা জরিপ করে দেখেছি, নির্মাণকাজের সময় ইলিশের উৎপাদন কমেনি।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

পদ্মা সেতু প্রকল্পের মধ্যে একটি প্রাণী জাদুঘর ও বন্য প্রাণী অভয়াশ্রম নির্মাণ করার কথা...

ফিরোজ আহমেদ: যমুনা সেতু এলাকায় আমরা একটি প্রাণী জাদুঘর করেছিলাম। পদ্মা সেতুর জাদুঘরটি আরও বড় আকারে করা হয়েছে। সেখানে প্রায় ৫০০ বন্য প্রাণী থাকবে। এই জাদুঘর মূলত শিক্ষার কাজে ব্যবহার হবে। সেতু এলাকা ঘিরে বন্য প্রাণী অভয়াশ্রম নির্মাণের কাজও চলছে। মূলত ইলিশসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর বিচরণ ও প্রজননের জন্য এই অভয়াশ্রম করা হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছে। এটি দুবার জাতীয় বৃক্ষরোপণ পুরস্কার পেয়েছে।

প্রশ্ন :

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

ফিরোজ আহমেদ: জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে দেশে এটিই প্রথম বড় প্রকল্প। আগামী ১০০ বছরে পদ্মা নদীর ওই অংশের বৃষ্টি, তাপমাত্রাসহ আবহাওয়ার অন্যান্য বিষয় আমরা হিসাব করেছি। তাতে দেখা গেছে, আগামী ১০০ বছরে সেখানে ২৬ শতাংশ বৃষ্টি বাড়বে। এতে সেখানে পানির প্রবাহ ১৬ শতাংশ বাড়বে। বাড়তি পানির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সেতুর নকশা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে পদ্মার পানির উচ্চতা দশমিক ৪ মিটার বাড়তে পারে। এ কারণে সেতুর উচ্চতা দশমিক ৪ মিটার বাড়ানো হয়েছে। প্রতি সেকেন্ডে ১৫০ কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হবে। এ ধরনের পানিপ্রবাহ একমাত্র আমাজান নদীতে দেখা যায়। ওই নদীর ওপরে কোনো সেতু নেই। এ ধরনের শক্তিশালী নদীর ওপরে পদ্মা–ই হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম সেতু।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পরিবেশ সুরক্ষার মানদণ্ড কি আন্তর্জাতিক মানে হয়েছে?

ফিরোজ আহমেদ: পদ্মা সেতুর পরিবেশগত সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়েছে। সেখানে সব ধরনের ডলফিন, পাখি, উদ্ভিদের হিসাব আমরা করেছি। একটি বন্য প্রাণী পর্যবেক্ষণ দল পাঁচ বছর ধরে তিন মাস পর পর পরিবেশ ও বন্য প্রাণীর ওপরে পর্যবেক্ষণ করছে। তাতে আমরা দেখেছি, সেতুর কারণে বন্য প্রাণীর কোনো ক্ষতি হয়নি। আশা করি, ভবিষ্যতেও হবে না।