১৮ মাস চেয়ারে, ২২ মাস জেলে

>২০১৩ সালে পাঁচ সিটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীরা। এর মধ্যে বরিশালের মেয়র ছাড়া মামলার অজুহাতে বাকি চার মেয়রকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। খুলনা সিটি মেয়র আদালতের রায়ে দায়িত্বে পুনর্বহাল হয়েছেন। গাজীপুর, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন এখনো ‘অভিভাবকহীন’ অবস্থায়। এই তিন সিটির হালচাল নিয়ে আজ থেকে পড়ুন প্রথম আলোর ধারাবাহিক অনুসন্ধান ‘অভিভাবকহীন তিন সিটি’।

নির্বাচিত হওয়ার পর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এম এ মান্নান দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছেন ১৮ মাস। জেলে কাটিয়েছেন ২২ মাস। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৯টি। বরখাস্ত হয়েছেন দুবার। সম্প্রতি তিনি কারামুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এখনো মেয়রের চেয়ার ফিরে পাননি।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজনৈতিক উত্তাপহীন এই সময়ে মেয়র এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে মামলা এবং তাঁর মুক্তির ঘটনা গাজীপুরে অন্যতম আলোচিত বিষয়। কারণ, মেয়র হয়ে তিনি যত দিন চেয়ারে বসেছেন, তার চেয়ে ঢের বেশি কাটিয়েছেন কারাগারে। বিশেষ করে সাড়ে তিন বছরে ২৯টি মামলা এবং দুই দফায় বরখাস্তের ঘটনাকে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে দেখছেন অনেকে। তাই মুক্তি পেলেও তিনি যে শিগগিরই মেয়র পদ ফিরে পাচ্ছেন না, এটিও এখন লোকজনের মুখে মুখে। তাঁর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হয়েছেন আওয়ামী লীগদলীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসাদুর রহমান।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাপুরের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব আলী আকবরের সঙ্গে কথা হয় শহরের রাজবাড়িতে। মেয়র মান্নানের বরখাস্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হুনছি, মেয়র খারাপ কাজ করছে। কী করছে জানি না। এহন তারে বাদ দিয়া আরেকজনরে বানাইছে।’

গাজীপুর সিটি নির্বাচন হয়েছিল ৪২ মাস আগে, ২০১৩ সালের ৬ জুলাই। প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আজমত উল্লাহর চেয়ে সোয়া লাখেরও বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হন এম এ মান্নান। নির্বাচনের দেড় মাস পর ১৮ আগস্ট তিনি দায়িত্ব নেন। ১৮ মাসের মাথায় ২০১৫ সালের ১১
ফেব্রুয়ারি পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে জয়দেবপুর থানার একটি নাশকতার মামলায়। ১২ মাস ১৮ দিন কারাভোগের পর গত বছরের ২ মার্চ তিনি মুক্তি পান। ৪২ দিনের মাথায় ১৫ এপ্রিল আবার গ্রেপ্তার হন তিনি। ৮ মাস ২২ দিন কারাবন্দী থাকার পর ৭ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় মুক্তি পান।

এসব মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লোক মুখে মামলা নিয়ে নানা কথা শুনি। তবে, একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কোনো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে মিথ্যা, হয়রানিমূলক মামলা সমর্থন করি না।’

জাহাঙ্গীর আলম সিটি নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আজমত উল্লাহর সমর্থনে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান।

আদালত ও থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এম এ মান্নান প্রথম কারাগারে যান নাশকতার একটি মামলা নিয়ে। এরপর কারাগারে থাকা অবস্থায় তাঁকে পর্যায়ক্রমে আরও ২১টি মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। ২২টি মামলায় জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ দফায় মামলা হয় আরও আটটি। এর মধ্যে একটি চাঁদাবাজির মামলা বাদে সবগুলোই বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের।

মামলার নথিপত্রে দেখা যায়, নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট সারা দেশে যে আন্দোলন করেছিল, মামলাগুলো ওই সময়কার। যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, পেট্রলবোমা হামলাসহ নাশকতার ঘটনায় গাজীপুরে মামলাগুলো হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৫টি বাদে ২৯টি মামলার অন্যগুলোর এজাহারে মান্নানের নাম ছিল না। এসব মামলায় কারাবন্দী অবস্থায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় কোনো প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই।

আদালতের নথিপত্র ও থানা সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মেয়র মান্নানের বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজির মামলা হয় জয়দেবপুর থানায়, যখন তিনি কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। যেদিন মান্নান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় জামিন বহালের রায় পান, সেদিনই এ মামলাটি করা হয়। পুলিশ এ মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখালে তিনি আর মুক্তি পাননি।

এম এ মান্নানের আইনজীবীরা বলছেন, তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো ভিত্তিহীন। এর মধ্যে চাঁদাবাজির মামলাটি যে কতটা পাতানো, তা বাদীর এজাহারেই দৃশ্যমান। এজাহারে টঙ্গীর শিলমন এলাকার বাসিন্দা মো. রমিজ উদ্দিন অভিযোগ করেন, নিজের জমিতে একটি কারখানা করার অনাপত্তি সনদ নিতে তিনি মেয়র মান্নানের কার্যালয়ে যান। এ সময় মেয়র তাঁর কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে মেয়রের হুকুমে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীসহ আট-নয়জন তাঁকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। একপর্যায়ে মেয়র গলা চেপে ধরে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেন। এ সময় আসামিরা তাঁর কাছ থেকে ৫৫ হাজার টাকা ও একটি মুঠোফোন ছিনিয়ে নেন।

এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী, চাঁদাবাজির ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। কিন্তু তিনি মামলা করেন ঘটনার ২৬ মাস পর। এত দেরির কারণ এজাহারে উল্লেখ নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মান্নানের আইনজীবী ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যখন মেয়র সব মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান, তখনই তাঁকে আটকানোর জন্য চাঁদাবাজির মামলাটি করানো হয়।

বিএনপি বলে আসছে, আওয়ামী লীগদলীয় লোকদের সিটি করপোরেশনে বসাতেই সরকার বিরোধী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে বরখাস্ত করছে। মেয়র মান্নানও দাবি করেন, যাঁরা তাঁর সঙ্গে নির্বাচনে হেরেছে, ওই মহল তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলার নেপথ্যে কাজ করেছে। তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে সিটি করপোরেশন দখল করে লুটপাট করার জন্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের এসবে জড়িত থাকার সুযোগ নেই। তবে এটা তো ঠিক, ওই সময় টানা ৯০ দিন জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে। তিনি (এম এ মান্নান) আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। সুতরাং এসব মামলার যথার্থতা আছে।’

নির্বাচনে এম এ মান্নানের প্রতিদ্বন্দ্বী ও গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ বলেন, ওই সময় দেশে অরাজকতা হয়েছে, পেট্রলবোমা মেরে ঘুমন্ত মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। এখন কে দায়ী বা কার দায়বদ্ধতা, তার জন্য তো আদালত আছেন। সরকার তো আদালতে হস্তক্ষেপ করছে না।

অবশ্য মান্নানের আইনজীবী ও গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. সহিদউজ্জামানের বক্তব্য ভিন্ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২৯ মামলার একটিতেও এম এ মান্নান গাজীপুর থেকে জামিন পাননি, সব জামিন হয়েছে উচ্চ আদালতে। এটা খুবই দুঃখজনক। অথচ, সাড়ে তিন লাখ ভোট পেয়ে তিনি গাজীপুরের মেয়র হয়েছেন।

জানতে চাইলে মেয়র মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে আমাকে এক নম্বর আসামি করত। কিন্তু মামলার সময় আমার নামে মামলা দিল না, অথচ ঘটনার এক বছর পর আমাকে গ্রেপ্তার দেখায়, কেন?’

জানা গেছে, নতুন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে যখন এম এ মান্নানের মুক্তি আটকে দেওয়া হচ্ছিল, তখন তাঁর আইনজীবীরা একটি রিট আবেদন করেন। রায়ে হাইকোর্ট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারার (প্রাথমিক তদন্ত সম্পন্ন) পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করে তাঁকে গ্রেপ্তার না করার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া কারামুক্তির পর জেলগেটে আটক করা যাবে না বলেও আদেশে উল্লেখ করেন।

 স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সব মামলায় জামিনে মুক্তি পেলেও এম এ মান্নান শিগগিরই মেয়র পদে বসতে পারছেন না। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ের বরখাস্ত আদেশ বহাল আছে। মান্নানকে প্রথম দফায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয় ২০১৫ সালের ১৯ আগস্ট। একটি ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার পর মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার আইনে মেয়রের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেয়। মেয়র এর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে স্থগিতাদেশ পান। কিন্তু তিনি চেয়ারে বসতে পারেননি। তার আগেই (১৫ এপ্রিল, ২০১৫) তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর দুই দিন পর (১৮ এপ্রিল) আবার তাঁকে বরখাস্ত করে মন্ত্রণালয়। সিটি নির্বাচনের পর সাড়ে তিন বছর কেটে গেছে। দেড় বছর পর নতুন নির্বাচন হওয়ার কথা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুর মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এম এ বারি প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুর নতুন ও সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশন। এটিকে নবজাত শিশুর মতো লালন-পালন করতে হবে। তাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারাই এটি পরিচালিত হওয়া উচিত।
অারও পড়ুন: