১৯৭১ সালে শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা

১৯৭১ সালের ৯ মে গজারিয়ার ১০টি গ্রাম থেকে প্রায় ৩৬০ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
১৯৭১ সালের ৯ মে গজারিয়ার ১০টি গ্রাম থেকে প্রায় ৩৬০ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। ছবি: সংগৃহীত
>১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড চালায়। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বিশ্বে নজিরবিহীন। এখনো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি মেলেনি। বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয় ৩০ লাখ মানুষ। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড চলে। বধ্যভূমিতে অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। ৬৪ জেলার গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধারাবাহিকভাবে থাকবে প্রথম আলোর নাগরিক সংবাদে। আজ থাকছে শরীয়তপুর ও মুন্সিগঞ্জের গণহত্যা, বধ্যভূমি ও গণকবরের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

শরীয়তপুর
নড়িয়ায় গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২২ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৫০ জন সেনা নিয়ে লঞ্চের করে মাদারীপুর থেকে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় আসে। এখানে এসে ঘড়িসার বাজার, ঝালোপাড়া ও ঘোষপাড়া গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয়। ঘোষপাড়া গ্রামের নালিত ঘোষকে ধরে একটি গাছের ঝুলিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই সঙ্গে পূর্ব নড়িয়া গ্রামের নাসিমা বেগম, কানাই ছৈয়ালকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। লোনসিং গ্রামে এসে এখানে চারজন পুরুষ ও তিনজন নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

ভেদরগঞ্জের মহিষার গণকবর
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভেদরগঞ্জের মহিষারে দুই শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোষরদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মহিষারেই ওই ১১ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধাকে গণকবর দেওয়া হয়।

পালং মধ্যপাড়া গ্রামে বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২২ মে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা শরীয়তপুরে পালং থানা (এখন সদর উপজেলা) মধ্যপাড়া গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে অসংখ্য নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করে। এখানে রাজাকারদের সহযোগিতায় নীলকান্দি, কাশাভোগ এলাকার হিন্দু–অধ্যুষিত এলাকায় ব্যাপক অত্যাচার চালিয়ে প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। হত্যার পর তাঁদের মনোহর বাজারের আশপাশে গণকবর দেওয়া হয়।

এ ছাড়া সদরের উত্তর দক্ষিণ মধ্যাপাড়া, মালো পাড়া, ঝালো পাড়া, কাশাভোগ, নীলকান্দি, আংগারিয়া বাজার, ধানুকা, পাল বাড়ি, কোটাপাড়া বাজার, নড়িয়া থানার গোলার বাজার, তেলিপাড়া, ভূমখাড়া বিঝারি গ্রামের হিন্দু ও মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। স্বজনদের সামনে অসংখ্য হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরুষকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করা হয়।

মুন্সিগঞ্জ
মুন্সিগঞ্জের কেন্দ্রীয় বধ্যভূমি
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বরে ভোরে মুন্সিগঞ্জ শহর ছেড়ে যাওয়ার পর সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পাসের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ৩৬ জনের লাশ পাওয়া যায়। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ৯ মে প্রায় ২০০ সেনাসদস্য নিয়ে হরগঙ্গা কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে। কলেজের তিনতলাবিশিষ্ট ছাত্রাবাসে পাকিস্তানি সেনারা থাকতেন। এখানে আশপাশের মানুষদের ধরে নিয়ে এসে নির্যাতন চালাতেন। নির্যাতন শেষে তাঁদের গুলি করে হত্যা করার পর এখানে একটি গর্তের মধ্যে লাশগুলো ফেলা হতো।

সাতানিখিল বধ্যভূমি
সাতানিখিল বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৩ মে রাত সাড়ে তিনটায় ঘেরাও করে সদর উপজেলার কেওয়ার চৌধুরীবাড়ি। ওই বাড়ি থেকে ডা. সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা ও তাঁর দুই ছেলে শিক্ষক সুনীল কুমার সাহা, দ্বিজেন্দ্র লাল সাহা এবং অধ্যাপক সুরেশ ভট্টাচার্য, শিক্ষক দেব প্রসাদ ভট্টাচার্য, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর শচীন্দ্র নাথ মুখার্জিসহ ১৭ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে আসে। ১৪ মে সকাল ১০টায় কেওয়ার সাতানিখিল গ্রামের খালের পাড়ে নিয়ে চোখ বেঁধে ১৬ জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। আর ডা. সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহাকে ধরে নিয়ে যায় হরগঙ্গা কলেজের সেনাক্যাম্পে। সেখান থেকে আর তিনি ফিরে আসেননি।

পাঁচঘড়িয়াকান্দি বধ্যভূমি
পাঁচঘড়িয়াকান্দি (চর শিলমন্ডি) গ্রামের একটি বাগানবাড়ির গাছে ঝুলিয়ে ব্রাশফায়ার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অসংখ্য সাধারণ মানুষকে হত্যা করে।

শরীয়তপুরে ভেদরগঞ্জ, পালং মধ্যপাড়া গ্রামসহ অনেক এলাকার মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। ছবি: সংগৃহীত
শরীয়তপুরে ভেদরগঞ্জ, পালং মধ্যপাড়া গ্রামসহ অনেক এলাকার মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। ছবি: সংগৃহীত

আবদুল্লাহপুরের পালবাড়ি বধ্যভূমি
টঙ্গীবাড়ির আবদুল্লাহপুরের বাড়িটিতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক বৃষ্টিভেজা দিনে আক্রমণ চালিয়ে এ বাড়ির মালিক ও অশ্রিতসহ ১৯ জনকে হত্যা করে। বাড়ির মালিক অমূল্যধন পাল, তাঁর ভাই মনোরঞ্জন পাল, মিহির পালসহ আত্মীয়স্বজন ওই বাড়িতে ছিল। দিনদুপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ওই বাড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে লুটপাট, হত্যাসহ নানা রকমের নির্যাতন চালায়। পরে মৃতদেহগুলো বাড়ির পুকুরপাড়ে ফেলে রেখে চলে যায়।

গোসইরচর বধ্যভূমি
গজারিয়া টিঅ্যান্ডটি অফিসের কাছের পাকা ব্রিজের কাছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় গণকবর। এখানে শতাধিক শহীদদের গণকবর দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৯ মে গোসইরচর গ্রামে ১৩৫ জন নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

গজারিয়ার গণহত্যা
১৯৭১ সালের ৯ মে মাসে গজারিয়ার ১০টি গ্রাম থেকে প্রায় ৩৬০ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল নয়ানগর। এ ছাড়া প্রধানের চর, বালুরচর, নাগেরচর, কলসেরকান্দি ও দড়িকান্দি এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গণকবর।

মাথাভাঙা খাল বধ্যভূমি
গজারিয়ার সোনালি মার্কেটের পূর্বে পাশে মাথাভাঙা খাল। এখানে ঢাকা থেকে আসা ৩০টি হিন্দু পরিবারকে হত্যা করার পর মাথাভাঙা খালে ফেলে রেখে যায়। এরপর অসংখ্য মানুষকে হত্যার পর ফলুদী নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

এ ছাড়া কাজীপুরা বধ্যভূমি, করিংখা বধ্যভূমি, ভবেরচর কলেজ রোড বধ্যভূমি, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বর্তমান মেঘনা-গোমতী সেতুর পাশে বাউশিয়া ফেরিঘাট বধ্যভূমি (পুরোনো সিঅ্যান্ডবি ফেরিঘাট) উল্লেখযোগ্য।

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ’৭১-এর গণহত্যা ’৭১, আবু সাঈদ সম্পাদিত; একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, সুকুমার বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধ কোষ, তৃতীয় খণ্ড, মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত, দৈনিক পূর্বদেশ, যুদ্ধাপরাধ গণহত্যা ও বিচারের অন্বেষণ, ডা. এম এ হাসান, দৈনিক সংবাদ, ৬ মে ১৯৯৩, দৈনিক সংবাদ, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ , গণহত্যা গজারিয়া রক্ত মৃত্যু মুক্তি, সাহাদাত পারভেজ, দৈনিক সংবাদ, ১৮ জুন ১৯৯৩

*এই দুই এলাকার গণহত্যা, গণকবর কিংবা বধ্যভূমিসংক্রান্ত আরও যদি খবর থাকে, অনুগ্রহ করে মেইলে জানাবেন।

আবু সাঈদ: কবি, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক
[email protected]