২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসনের সম্ভাবনা, গোলটেবিলে বক্তারা

শিশুশ্রম নিরসনে সরকার বদ্ধপরিকর। দেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় শিশুশ্রমকে একেবারে ‘না’ বলতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০২৫ সালের মধ্যে দেশ থেকে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসন করার লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলেও এ সময়ের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসন করতে হবে। 

আজ বুধবার ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস: বাংলাদেশ পরিস্থিতি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এ কথা বলেছেন। বৈঠকটির আয়োজন করে প্রথম আলো। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা আছে। কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরকে কারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা আছে কি না, তা দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৭০টি কারখানার মালিকের বিরুদ্ধ মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত এক লাখ শিশুকে শ্রম থেকে বের করে এনে পুনর্বাসনের জন্য সরকার ২৮৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে।
সরকার এখন পর্যন্ত শিশুর কাজের জন্য ন্যূনতম বয়সসীমা নির্ধারণ-সংক্রান্ত আইএলওর কনভেনশন ১৩৮ অনুসমর্থন করেনি বলে উল্লেখ করেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, সরকার যত কার্যক্রমই হাতে নিক বা যত আইনই থাকুক, বাবা-মা এবং নিয়োগকর্তা সচেতন না হলে শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভব নয়। নির্বাচনের পর আবার যদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান, তাহলে গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় আইন প্রণয়ন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন মুজিবুল হক।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খোন্দকার মোস্তান হোসেন বলেন, শিশুশ্রম নিরসনের বিষয়টিতে সরকার গুরুত্ব দিয়েছে বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিভাগীয় কমিশনার বরাবর শিশুশ্রম পরিস্থিতি জানানোর জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে এ প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক মো. সামছুজ্জামান ভূইয়া বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে আইনে কঠিন কঠিন কথা বলা আছে। আইন বাস্তবায়ন করতে হাজার হাজার মামলাও করা যায়। শিশুদের কাজ থেকে সরিয়ে আনা যায়। কিন্তু এরপর এই শিশুরা কোথায় যাবে? তাঁরা ঝুঁকি থেকে ঝুঁকিতর পথে পা বাড়াবে। তাই বাস্তবতার কথা চিন্তা করেই সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
আলোচনায় আইএলওর পরিচালক তুমো পতিনাইন আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুসমর্থনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
আইএলওর প্রোগ্রাম অফিসার মুনিরা সুলতানা কেউ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দিলে তার জন্য আইনে জরিমানার পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করেন।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান জ্যঁ লিবি বলেন, শিশু শ্রমিক, বিশেষ করে গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত শিশুদের অনেকেই বেতন কম পাচ্ছে, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সপ্তাহের সাত দিনই এই শিশুদের কাজ করতে হচ্ছে। তিনি শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের কর্মকৌশল বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।
গোলটেবিল বৈঠকে এনজিও অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের পক্ষ থেকে দুজন শ্রমজীবী শিশু তাদের অনুভূতির কথা জানায়। গৃহশ্রমিক মনিরা আক্তার জানায়, সে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। এরপর তাকে কাজে দিয়ে দেন বাবা-মা। কিন্তু তার কাজ করতে ভালো লাগে না। সুযোগ পেলে সে পড়াশোনা করতে চায় বলে জানায়।
লেগুনার সহকারী হিসেবে কর্মরত শিশু রাব্বি বলে, ‘ভাড়া নিতে গেলে যাত্রীরা বাজে গালি দেয়। থাপড় মারে। মারধর করে। চলন্ত গাড়ি থেইক্যা নিচে পইড়া যাই।’
টেম্পোচালক মো. মল্লিক চান বলেন, ‘খাইবার পারি না বইল্যা এই শিশু, এমনকি তাদের বাপ-মা পর্যন্ত কান্নাকাটি শুরু করে। বাধ্য হইয়্যা কাজে নিতে হয়।’
সাময়িক লাভের জন্য শিশুদের দিয়ে কাজ করানোর ফলে ভবিষ্যতের অশনিসংকেতের কথা তুলে ধরেন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর ১৫০টি খাতের মধ্যে মাত্র তিনটি খাত রাখা হয়েছে শিশুদের জন্য। শ্রমে যুক্ত শিশুরা মানসিকভাবে সহিংস, স্নেহবঞ্চিত, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলভাবে বড় হচ্ছে। এই শিশুরা বড় হয়ে মাদকের বিস্তার ঘটাতে পারে। মৌলবাদের উত্থানে ভূমিকা রাখতে পারে।
মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী সরকারের ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির কো-চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে নজরদারির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসন করতে হলে রোডম্যাপ করে অগ্রসর হতে হবে। তিনি শিশু গৃহশ্রমিকদের সরকারের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের মহাসচিব ফারুক আহাম্মাদ বলেন, শ্রমে নিযুক্ত শিশুদের শ্রম থেকে বের করে এনে স্কুলে ভর্তি করা হচ্ছে। এরপর খুব বেশি হলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে পারছে। এরপর আর পড়তে পারছে না। এদের দক্ষ শ্রমিকে পরিণত করতে হলে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর পরিচালক আনজীর লিটন বলেন, চলতি বছর থেকে শিশু একাডেমী গ্রামীণ শিশুদের সৃজনশীলতার বিকাশে কাজ শুরু করবে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে এই শিশুদের বাবা-মাকে সচেতন করা গেলে শিশুশ্রম নিরসন করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুছ সহিদ মাহমুদ শিশু শ্রমিকদের সঠিক পরিসংখ্যানের অভাবে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। গৃহশ্রমিক এবং পরিবহন খাতে শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়লেও সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের পরিচালক চন্দন জেড গোমেজ জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১০ লাখ শিশু সম্পৃক্ত হয়েছে, যারা গ্রাম ও শহরে শিশু ফোরাম গড়ে তুলেছে। তাদের মূল কাজ, কোনো শিশু কাজে যোগ দিল কি না, কোনো শিশু পড়া ছেড়ে দিল কি না, তা দেখা এবং প্রতিবেদন জমা দেওয়া।
সেভ দ্য চিলড্রেনের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর সাহিদা বেগম বলেন, শিশুদের শুধু শ্রম থেকে বের করে আনলেই হবে না, তাদের বা তাদের পরিবারের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি শিশুদের বয়সভিত্তিক কর্মকৌশল প্রণয়নের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।