২২ বছর পর আনুষ্ঠানিক সফরে ফ্রান্স যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ
ছবি: বাসস ও রয়টার্স

দীর্ঘ ২২ বছরের বিরতি শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী মাসে আনুষ্ঠানিক সফরে ফ্রান্স যাচ্ছেন। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেষবার আনুষ্ঠানিক সফরে প্যারিস গিয়েছিলেন।

এবারের আনুষ্ঠানিক সফরটি পাঁচ দিনের। সফরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্যারিসের অ্যালিসি প্রাসাদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন।

বাংলাদেশ-ফ্রান্সের সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তি সামনে রেখে দুই শীর্ষ নেতার আসন্ন বৈঠকের মধ্য দিয়ে সহযোগিতার নতুন পথনকশার একটি দিকনির্দেশনা আসতে পারে বলে কূটনীতিকেরা জানিয়েছেন।

ঢাকা ও প্যারিসে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা গত শুক্রবার প্রথম আলোকে জানান, ফরাসি সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকে আনুষ্ঠানিক সফর হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে শেষবার আনুষ্ঠানিক সফরে ফ্রান্স গিয়েছিলেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, আসন্ন সফরের খসড়া সূচি অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জঁ কাসতেক্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ ইভস লো দ্রিখাঁ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্লের সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে ফ্রান্সের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে শেখ হাসিনার মতবিনিময়ের প্রস্তুতি চলছে।

সফরকালে আগামী ১১ নভেম্বর সৃজনশীল অর্থনীতিতে অবদানের জন্য প্রবর্তিত ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার হস্তান্তর করবেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থায়নে এই পুরস্কার প্রবর্তন করে ইউনেসকো।

সফরের শেষ দিনে প্যারিস পিস ফোরামের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে।

সাধারণত আনুষ্ঠানিক বৈঠকে সহযোগিতার নানা বিষয়ে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সই হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন প্যারিস সফরেও একাধিক চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তুতি রয়েছে। তবে সংযুক্তি ও ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত এই দলিলগুলো সইয়ের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই শীর্ষ নেতা আগামী ৯ নভেম্বর অ্যালিসি প্রাসাদে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিদায়ের পর ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গে আমরা সম্পর্কের গুণগত পরিবর্তন আনতে চাই। বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ক কোথায় যাবে, তার একটি দিকনির্দেশনা থাকতে পারে। আমরা দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বা বহুপক্ষীয় সহযোগিতার নানা বিষয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী।’

মাসুদ বিন মোমেন জানান, গ্লাসগোর জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের পর অনুষ্ঠেয় প্যারিসের বৈঠকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির বিষয়টি আলোচনায় আসবে। বিশেষ করে জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস জলবায়ু চুক্তি কার্যকর করতে উদ্যোগ নিয়েছে। আবার বাংলাদেশ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জোট সিভিএফের প্রেসিডেন্ট। স্বাভাবিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে গুরুত্ব পাবে।

দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্ক কোথায় যাবে, তার একটি দিকনির্দেশনা থাকতে পারে
মাসুদ বিন মোমেন, পররাষ্ট্রসচিব

সম্পর্কের নতুন মোড়

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরপরই যে দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, ফ্রান্স তার মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে ফরাসি দার্শনিক আন্দ্রে মালরোঁর বিশেষভাবে অবদান রেখেছিলেন।

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ফ্রান্স।

১৯৯০ সালে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরার বাংলাদেশ সফরের পর দুদেশের সম্পর্কে বাঁকবদলের সূচনা হয়। তার ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৯ সালে প্যারিসে আনুষ্ঠানিক সফরে যান।

শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ওয়ান প্ল্যানেট সামিটে অংশ নিতে শেষবারের মতো প্যারিস সফরে যান। ওই সফরের ফাঁকে তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে বৈঠক করেন।

বাংলাদেশ-ফ্রান্সের সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তি সামনে রেখে দুই শীর্ষ নেতার আসন্ন বৈঠকের মধ্য দিয়ে সহযোগিতার নতুন পথনকশার একটি দিকনির্দেশনা আসতে পারে বলে কূটনীতিকেরা জানিয়েছেন।

সহযোগিতার নানা দিক

দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের হিসেবে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ফ্রান্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ইউরো। এর মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ২ বিলিয়ন ইউরোর বেশি। ফ্রান্সে বাংলাদেশের রপ্তানির ৯০ শতাংশ তৈরি পোশাক। বাকি ১০ শতাংশ চামড়া-চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ ও ওষুধ। ফ্রান্স থেকে গাড়ি ও উড়োজাহাজের যন্ত্রপাতি, পানীয় ও খাদ্য উৎপাদনের রাসায়নিক দ্রব্য আমদানি করে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য ফরাসি বিনিয়োগ হচ্ছে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট। এ ছাড়া চট্টগ্রামে কারখানা করেছে ফ্রান্সের খ্যাতনামা জ্বালানি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টোটাল। অ্যাভেনটিস, এডেক্স, ডানোন ও ভিওলার মতো ফ্রান্সের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আছে বাংলাদেশে।

২০১২ সাল থেকে ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (এএফডি) মাধ্যমে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিশ্চিতে তৈরি পোশাকশিল্পের সঙ্গে কাজ চলছে। খরচের সাশ্রয় ঘটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে একই ভবনে জার্মানির সঙ্গে দূতাবাস চালু করেছে ফ্রান্স। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রথম ফ্রাঙ্কো-জার্মান দূতাবাস চালু হয়।