২৮ লাখ পশু অবিক্রীত, ঈদে গরুর চেয়ে ছাগল কোরবানি বেশি

ফাইল ছবি

চলতি বছর কোরবানিযোগ্য ২৮ লাখ ২৩ হাজার ৫২৩টি পশু অবিক্রীত থেকে গেছে। এতে বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন খামারি-ব্যাপারীরা। করোনায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছর কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। তার মধ্যে কোরবানি হয়েছে মোট ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু।

অধিদপ্তরের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পশু কোরবানি হয়েছে এই ঈদুল আজহায়। করোনা সংক্রমণের আগে প্রতিবছর পশু কোরবানির পরিমাণ বাড়ছিল। সংক্রমণের পর থেকে তা ক্রমাগত কমছে।

তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ৯৮ লাখ ১৩ হাজার পশু কোরবানি হয়। তারপর থেকে ক্রমাগত বেড়ে ২০১৭ সালে ১ কোটি ৪ লাখ, ২০১৮ সালে ১ কোটি ৬ লাখ, ২০১৯ সালে ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার পশু কোরবানি হয়। ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে ওই বছর কোরবানি কমে হয় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩টি। চলতি বছর আরও কমে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু কোরবানি হলো।

রাজধানীর কোরবানির বাজারে বিক্রি না করতে পেরে সাতটি গরু ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন নরসিংদী সদরের মো. রফিকুল ইসলাম। শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ২৫টি গরু বিক্রি করার জন্য এনেছিলাম। তার মধ্যে ১৭টি গরু বিক্রি করতে পেরেছি। আমার সবগুলো গরু বড় ছিল, সবগুলোই ঘাটতিতে বিক্রি করেছি।’

খামারে যে গরু ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দর উঠেছিল, ঢাকায় এনে সেটা ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন তিনি। অথচ সেই গরুর পেছনে খরচ ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বলে জানান এই খামারি।

রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সাতটা গরু লালন–পালন করা যাবে দেখে ঘাটতি দিয়ে বিক্রি করিনি। যে ১৭টা ঘাটতি দিয়ে বিক্রি করেছি, সেগুলো লালন–পালন করলে যা খরচ হতো, তাতে আরও ঘাটতি হতো। এর বাইরে একটা গরু নিজে কোরবানি দিয়েছি।’
বাকি সাতটি গরুও বিক্রি করে দিয়ে এই ব্যবসা ছেড়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন বলে জানান এই খামারি।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, করোনা ও লকডাউনে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। তাই কোরবানির সংখ্যাও কমেছে। তা ছাড়া ঢাকায় যেসব গরু অবিক্রীত থেকেছে, তার বেশির ভাগই বড় গরু। যেগুলোর ক্রয়ক্ষমতা অনেকের নেই।

আর লকডাউন তুলে নেওয়া হয়েছিল ঈদের কয়েক দিন আগে। ফলে একবারে অনেক পশু ঢাকায় ঢোকে। ভোক্তারা যাচাই–বাছাই করার সুযোগ পেয়েছেন। ছোট গরু স্বাস্থ্যকর হওয়ার কারণে খুব কমসংখ্যক তা ফেরত গিয়েছে। ফেরত যাওয়া গরু বড়, যাদের শরীরে চর্বি ও কোলেস্টেরল বেশি। করোনার অনেকেই স্বাস্থ্য সচেতন। এ ছাড়া করোনায় পরিবারের সদস্য ও পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে কোরবানির প্রতি একধরনের অনীহা চলে এসেছে। অনেকে অনলাইনে অর্ডার দিয়েও টাকা ফেরত নিয়েছেন। মূলত এসব কারণে এবার কোরবানি কমেছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. শেখ আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পশু অবিক্রীত থাকায় যারা ক্ষতির মধ্যে পড়েছে তার মধ্যে খামারি প্রায় ২০-৩০ শতাংশ এবং প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ ব্যাপারী। গত বছরও ব্যাপারীরাই ক্ষতির মধ্যে পড়েছিলেন। কারণ, খামারিরা অল্প লাভে ছেড়ে দেন। ব্যাপারীরা বেশি লাভের আশায় থেকে ক্ষতির মুখে পড়েন।’

আজিজুর রহমান বলেন, ‘করোনায় মানুষের আয় কমে গেছে। তাই ছোট গরু পালন করতে হবে। ছোট গরু স্বাস্থ্যকর ও চাহিদা বেশি। ভবিষ্যতে ক্ষতি থেকে বাঁচতে আপাতত এটাই সমাধান।’

বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সাধারণ সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ এমরান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নিজেদের মতো করে একটা হিসাব করেছি, তাতেও দেখা গেছে প্রায় ২৮ লাখ কোরবানির পশু অবিক্রীত রয়ে গেছে। সামনে করোনা পরিস্থিতির কারণে যদি বিয়েও না থাকে, এগুলো খামারিদের খুচরা বিক্রি করতে হবে। অন্যদিকে বাজারে যে মাংসের দাম, তাও অনেকের পক্ষে কিনে খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। খামারিরা ইতিমধ্যে লোকসান দিয়েছেন, তাঁদের এই লোকসান নিয়েই চলতে হবে।’

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কয়েক মাস আগে বড় ধরনের জরিপ করেছিলাম। তাতে দেখেছি, ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে আড়াই থেকে তিন কোটি মানুষ নেমে গেছে। ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, কাজ হারানো, কাজের অনিশ্চয়তার কারণে কোরবানির সময় মানুষ যেভাবে খরচের যে পরিকল্পনা থাকে, সেটা এবার সম্ভব হয়নি।

সে কারণেই দেখছি যে কোরবানির পশুর বড় একটা অংশ অবিক্রীত থেকে গেছে।’
সেলিম রায়হান বলেন, ‘ভারত থেকে যেহেতু গরু আমদানি বন্ধ থাকায় অনেক খামারি আগ্রহ নিয়ে গবাদিপশু মোটাতাজাকরণ করেছিলেন। এ অবস্থায় যদি বড় ধাক্কা লাগে তাহলে অনেকেই গবাদিপশু পালনে আগ্রহী হবেন না। এই জায়গায় দুধ, মাংস, চামড়ায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের বড় ধরনের আর্থিক ও নীতিগত সহায়তার দরকার আছে। যেসব খামারি বা সংশ্লিষ্টরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের যদি করোনাকালীন প্যাকেজের আওতায় সহায়তা করা যায়, তাহলে হয়তো অনেকে কোনো না কোনোভাবে সামলে উঠতে পারবেন।’

এবার ছাগল-ভেড়া বেশি কোরবানি

২০১৭ সাল থেকে ছাগল/ভেড়ার তুলনায় গরু/মহিষ কোরবানি দেওয়ার পরিমাণ বাড়ছিল। তবে চলতি বছর এর ছেদ ঘটেছে। এ বছর ছাগল/ভেড়ার চেয়ে কম কোরবানি হয়েছে গরু/মহিষ।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছর ছাগল/ভেড়া কোরবানি হয়েছে ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি, আর গরু/মহিষ কোরবানি হয়েছে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি। যেখানে করোনার আগে ২০১৯ সালে ৫৭ লাখ ১১ হাজার ৪৩৪টি গরু/মহিষ কোরবানি হয়েছিল এবং ছাগল/ভেড়া ৪৯ লাখ ১ হাজার ১৮৮টি।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার ভেড়া-ছাগলের দাম অনেকটাই স্বস্তা ছিল। এ কারণে ভেড়া-ছাগল বেশি বিক্রি হয়েছে। তা ছাড়া করোনায় মানুষের আয় কমায় গরু, মহিষ কেনার ক্ষমতাও কমেছে।