৩১ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলের সুপারিশ

করোনার মধ্যে নতুন তালিকা প্রকাশ করার তিন মাস না পেরোতেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মির্জা ইসমতসহ ৩১ জনের মুক্তিযোদ্ধা গেজেট ও সনদ বাতিলের সুপারিশ করেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)।

অন্যদিকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও চার গুণ ভাতা নেওয়ায় ১৭ জনের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে তাঁরা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাবেন।

অসত্য তথ্য দেওয়া ও জালিয়াতির নানা অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করেন জামুকার মহাপরিচালক। এরপরই জামুকার ৬৮তম বৈঠকে এই ৩১ জনের নাম মুক্তিযোদ্ধা গেজেট থেকে বাতিলের সুপারিশ করা হয়।

‘ভুল হলে আমরা শুধরে নিচ্ছি। যে কেউ অভিযোগ করতে পারবে যেকোনো অমুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।
আ ক ম মোজাম্মেল হক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভুল হলে আমরা শুধরে নিচ্ছি। যে কেউ অভিযোগ করতে পারবে যেকোনো অমুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই তো আপিলের সুযোগ রাখা আছে।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এঁদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার মির্জা ইসমতকে অমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করে যাচাই–বাছাইয়ের সময় তাঁর নাম আগেই বাতিলের তালিকায় রেখেছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। অথচ ৩ জুন মির্জা ইসমতকেই যুক্ত করে ১ হাজার ২৫৬ জনকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

জামুকা সূত্রে জানা গেছে, এই ৩১ জনের মধ্যে চাঁদপুরের সফিকুর রহমান হাওলাদার জামুকার আইন অনুসরণ না করে গোপনে সনদ নিয়েছিলেন। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। নারায়ণগঞ্জের তারা মিয়া মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং করেননি, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অংশও নেননি। নওগাঁর খোরশেদ আলী মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা নন। একই জেলার নজরুল ইসলাম ও খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তার বিপক্ষে কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেননি তাঁরা। মাগুরার ফুল মিয়া যুদ্ধ করেননি, তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাও নন।

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল সূত্রে জানা গেছে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে কল্যাণ ট্রাস্ট ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিদিন নানা অভিযোগ আসছে। সরকার আলাদা করে যুদ্ধাহত ভাতা দেওয়ার ঘোষণার পর থেকেই অবৈধভাবে যুদ্ধাহত ভাতা পাওয়ার জন্য ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তুলছেন তাঁরা। অনেকের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্নই নেই। অনেকে অন্য দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হলেও নিজেদের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেছেন। এ জন্য জামুকার ৬৮তম বৈঠকে মুক্তিযোদ্ধারা সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে যুদ্ধাহত ভাতা নিচ্ছেন কি না, তা যাচাই–বাছাই করতে একটি কমিটি করা হয়। ওই কমিটির অনুসন্ধানে এই ১৭ জনের নাম বেরিয়ে আসে।

নিজেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে যে ১৭ জন প্রতারণা করেছেন, তাঁরা হলেন মোজাম্মেল হক, হাবিবুর রহমান, আনিসুর রহমান, আসগর, রইচ উদ্দিন, রুহুল আমিন, লোকমান হাকিম, মোসাদ্দেক হোসেন, মৃত আবেদ আলী, রুস্তম আলী, আবদুল লতিফ, আবদুর রাজ্জাক, মনসুর আলী, লিয়াকত আলী, মৃত মফিজ উদ্দিন, ইফতেখার আলম ও আবু হাসান প্রমুখ।

বিভিন্ন জেলার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও যাচাই–বাছাই কমিটির সদস্যদের মতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও দেশের যে কয়টি জেলার নতুন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তার অনেকগুলো নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। ফরিদপুরের সালথা উপজেলার নতুন ১১ মুক্তিযোদ্ধার অর্ধেকের নাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর নরসিংদীর নতুন তালিকা দেখে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এমন আরও কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর ‘একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা প্রকাশ—প্রথম পর্ব’ শিরোনামে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে সারা দেশে ক্ষোভ–বিক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে ওই তালিকা স্থগিত করা হয়।

‘নতুন তালিকা থেকে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তাঁদের সনদ ও গেজেট বাতিল করা হচ্ছে।
জহুরুল ইসলাম, জামুকার মহাপরিচালক

জামুকার মহাপরিচালক জহুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন তালিকা থেকে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে, তাঁদের সনদ ও গেজেট বাতিল করা হচ্ছে। এ ছাড়া জামুকার যে কর্মকর্তা অনিয়ম করেছেন, তাঁকে বরখাস্ত করে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। আমরা যেকোনো অভিযোগই খতিয়ে দেখছি।’