৩৯ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ছবি: সংগৃহীত

ভুল ব্যাখ্যা ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ (প্রত্যয়নপত্র) নেওয়ায় ৩৯ জন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার নির্দেশ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের কাছে এ নির্দেশ-সংবলিত চিঠি পাঠানো হয়েছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার সরেজমিন তদন্তের ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। ইতিমধ্যে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিল করা হয়েছে।
তবে অন্তত চারজন সচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও একজন সাবেক সচিব চাকরির মেয়াদ বাড়াতে বা অন্যান্য সুযোগ নিতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিলেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওই সচিবেরা এখনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। চাকরির শেষ সময়ে এসে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার এ খবর গত ২৩ জানুয়ারি প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল।
কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, সচিবদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো দুদক তদন্ত করে দেখছে।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে জানা যায়, ৩৯ কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন একজন বিচারক, চারজন নিরীক্ষক, দুজন ব্যাংকার, একজন শুল্ক কর্মকর্তা, একজন যুগ্ম পরিচালক ও দুজন প্রধান শিক্ষক। আছেন অফিস সহকারী, কেরানি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, এত দিন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় না দিলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। সনদ দেওয়ার আগে মুক্তিযোদ্ধা কি না, তা যাচাই-বাছাই করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেও তা মানা হয়নি। মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর না নিয়েই সনদ দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় শুধু সনদ বাতিল বা ফৌজদারি মামলা করা নয়, কেউ সনদ ব্যবহার করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকলে তা-ও ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখাতে পারলেই এক বছর বেশি চাকরি করা যায়। এই সুযোগ কাজে লাগাতে মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহের হিড়িক পড়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে। আর এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর পর। তবে এক বছর বেশি চাকরির সুযোগ ছাড়াও নিজের সন্তান এবং নাতি-নাতনিদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও চাকরির ক্ষেত্রে কোটা-সুবিধাও রয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা মাসিক সম্মানীও পেয়ে থাকেন। বর্তমানে প্রায় দুই লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে প্রায় দেড় লাখ সম্মানী পাচ্ছেন। অন্যরাও যাতে সম্মানী পান, এখন সে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টই বলা হয়েছে, কেউ মুক্তিযোদ্ধা হলে চাকরিতে যোগদানের সময়ই তাঁকে তা জানাতে হবে। পরে বললে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হবে না।

বাতিল হওয়া ৩৯ কর্মকর্তার মধ্যে প্রায় ২০ জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, তাঁরা সনদ বাতিলের বিষয়টি জানেন না। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা সুবিধা নিয়ে চাকরি করছেন। কেউ কেউ অবসরেও গেছেন।
গাজীপুরের জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মজিবর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘ভুল তথ্য দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমার কাছে সব তথ্য-প্রমাণ আছে। কেউ বললেই তো আর সনদ বাতিল হবে না।’ নেত্রকোনা দেবকান্দা স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিরাজ আলীর দাবি, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র আছে। চুয়াডাঙ্গা নূরনগরের যুগ্ম পরিচালক শেখ মোহাম্মদ রওশন আলী, ফরিদপুর নগরকান্দা আটকাহনিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক এস এম ইমান উদ্দিন, চাঁদপুরের প্রত্যাশী স্কুলের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলামও একই দাবি করেন।
মাগুরার নিরীক্ষক মোকছেদ আলী বলেন, ‘আমাকে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) ডাকা হয়েছিল, তদন্তও করা হয়েছে। তার পরও সনদ বাতিল হলে করার কী আছে। এমনিতেও আর আমি সনদের সুবিধা নেব না।’
৩৯ জনের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের পল্লী অবকাঠামো প্রকল্পের পরিচালক আতাউর রহমান, পাবনার রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের উপব্যবস্থাপক মো. আবুল কাসেম, কৃষি ব্যাংকের মুখ্য কর্মকর্তা শেখ জান মোহাম্মদ, চট্টগ্রামের যমুনা অয়েল কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপক গোলাম রব মোল্লা, কিশোরগঞ্জের চিকিৎসা কর্মকর্তা আলকাবুর রহমান, রেলওয়ের ডিইও আবদুল কাইয়ুম, ঢাকার আমির আলী (পদবি লেখা নেই), চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার কাজী আবদুল বাসিত, রাঙামাটি পার্বত্য জেলার চন্দ্রঘোনা কেপিএসের সাবেক জ্যেষ্ঠ কেরানি কোহিনুর মিয়া, মেহেরপুরের এসআই সোলায়মান আলী, মৎস্য অধিদপ্তরের ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্য চাষ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক জোয়ার্দার মো. আনোয়ারুল, ভোলার ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের মোশারেফ হোসেন, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের ইমাম মফিজুল ইসলাম, চাঁদপুর আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক তাজুল ইসলাম খান, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কারখানা বিভাগের কার্য সহকারী নজরুল ইসলাম, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের পরিচালক এস এম সাইদুর রহমান চৌধুরী, মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের জ্যেষ্ঠ নিরীক্ষক সহকারী শাহাবুদ্দিন চৌধুরী ও ছাদেক আলী, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অটোগেজ অপারেটর অহিদুজ্জামান, মাগুরার এসআই শামছুর রহমান গাজী, বিসিআইসির নিরাপত্তা হাবিলদার কে এম বাবলু, রায়পুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের সহকারী গোলাম মোস্তফা, মুন্সিগঞ্জের সহকারী ফোরম্যান জয়নাল আবেদীন, বরিশাল সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমির হোসেন, আবদুল আজিজ, চাঁদপুরের টিএসআই নুরন্নবী পাটোয়ারী, সাতক্ষীরা উপজেলা শিক্ষা অফিসের কম্পিউটার অপারেটর/অফিস সহকারী আবুল হোসেন।

বারবার তালিকা:

সরকার পরিবর্তন হলেই মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে প্রকৃত মৃক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। বিভিন্ন সরকারের সময় এ পর্যন্ত পাঁচটি তালিকার খবর পাওয়া যায়।
সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। ১৯৮৬ সালে এরশাদের আমলে জাতীয় তালিকায় (গেজেট হিসেবে প্রকাশিত হয়নি) এ সংখ্যা ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮। ১৯৯৪ সালে বিএনপির আমলে নতুন তালিকাভুক্ত হন ৮৬ হাজার। আর মহাজোট সরকারের পাঁচ বছরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন।