৪ বছর চালিয়ে ২৫ বছরের অবহেলা

ফ্রান্সের অনুদানে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতাল। ১৪ শতাংশ জমির ওপর গড়ে ওঠা হাসপাতালটি এখন পরিত্যক্ত।

দুই যুগের বেশি সময় ধরে পুরো ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালের কোনো রকম কার্যক্রম নেই। জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকতে থাকতে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্যান্য যানবাহনে গজিয়ে উঠেছে গাছপালা। গত মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডে
ছবি: আশরাফুল আলম

নামফলকে লেখা—জরুরি বিভাগ। ভেতরে তিনটি খাট, চেয়ার-টেবিল। ফ্যানও ঘুরছে। আছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগও। নেই শুধু চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। যেখানে রোগীর চিকিৎসা হওয়ার কথা, সেখানে এখন থাকেন নিরাপত্তাকর্মীরা।

এটি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে প্রতিষ্ঠিত ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালের চিত্র। ১৯৯১ সালে রাজধানীর মিরপুরে চিড়িয়াখানা সড়ক নামে পরিচিত বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দিন সড়কে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কথা ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এতে সাশ্রয়ী মূল্যে চিকিৎসা পাবেন। পাশাপাশি সাধারণ মানুষও চিকিৎসা নিতে পারবেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর
মাত্র চার বছর চালু ছিল। ১৯৯৫ সাল থেকে ২৫ বছর ধরে অবহেলায় পড়ে থেকে হাসপাতালটি পরিত্যক্ত হয়ে গেছে।

ঢাকায় গত ২৫ বছরে সরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন হাসপাতাল হয়েছে। পুরোনো হাসপাতাল সম্প্রসারিত হয়েছে। মিরপুরেই গড়ে উঠেছে অনেকগুলো বেসরকারি হাসপাতাল। শুধু চালানো যায়নি ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালটি। অথচ সেটি চালু থাকলে মুক্তিযোদ্ধারা যেমন চিকিৎসাসেবা পেতেন, তেমনি সুফল পেতেন স্থানীয়রাও।

সেই আক্ষেপের কথাই বললেন হাসপাতালটির পাশের মুদিদোকানি মনির হোসেন। তিনি বলেন, কিশোর বয়সে তিনি হাসপাতালটি তৈরি করতে দেখেছেন। চালু হওয়ার পর মানুষ সেখানে চিকিৎসা নিত। কিন্তু অল্প কয়েক বছর পরই সেটি বন্ধ হয়ে গেল। তিনি বলেন, এখন চিকিৎসার জন্য শ্যামলী যেতে হয়।

মুক্তিযোদ্ধারাও চান তাঁদের জন্য একটি নির্ধারিত হাসপাতাল থাকুক। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল করা হোক, এটা আমাদের বহু বছরের দাবি। প্রতিটি সরকারেরই নির্বাচনী প্রচারে মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতাল করার প্রতিশ্রুতি থাকে। কিন্তু তা আর হয় না।’ তিনি বলেন, মিরপুরের হাসপাতালটিও নানা অজুহাতে বহু বছর ধরে বন্ধ রয়েছে।

ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় অনুদান দিয়েছিল ফ্রান্স সরকার। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কর্মকর্তারা জানান, ফ্রান্সের অর্থায়নে তখন দুই বছর হাসপাতালটি চলে। সে সময় জরুরি বিভাগটি ২৪ ঘণ্টা চালু ছিল। তবে রোগীর সংখ্যা একেবারেই কম ছিল। ১৯৯৩ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হাসপাতালটি ইজারা নিয়ে ইসলামি উম্মাহ মেডিকেল কলেজ নামে দুই বছর চালায়। ১৯৯৫ সাল থেকে হাসপাতালটি একেবারেই অযত্নে পড়ে আছে। হাসপাতালের জমির পরিমাণ মোট ১৪ শতাংশ।

গত সোমবার সরেজমিনে ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালে দেখা যায়, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে পরিত্যক্ত দুটি অ্যাম্বুলেন্স পড়ে আছে। সেগুলোর গায়েও ‘আধুনিক হাসপাতাল’ কথাটি লেখা। অ্যাম্বুলেন্সের ফাঁকফোকরে বেশ বড় বড় গাছ গজিয়েছে। পাশেই একটি ব্যক্তিগত গাড়ি বা প্রাইভেট কার, ভ্যান, অটোরিকশাসহ কিছু যানবাহন পড়ে আছে। সব কটির অবস্থা শোচনীয়। হাসপাতাল প্রাঙ্গণটি মোটামুটি জংলায় পরিণত হয়েছে।

সংস্কার করে ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালকে অন্য কোনো একটি হাসপাতালের অংশ করা যেতে পারে অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে কোনো উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
সারওয়ার আলী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি

হাসপাতালটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা সংস্থা বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট বলছে, এ দায়িত্ব তাদের নয়। কারণ, হাসপাতালের মালিকানায় তারা নেই। ফলে হাসপাতালটি কী করা হবে, সে সম্পর্কে ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ জানে না।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইফতেখারুল ইসলাম খান বলেন, ‘এটা আমাদের হাসপাতাল নয়। আমাদের এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনাও নেই। হাসপাতালের দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের। হাসপাতালটি বছরের পর বছর কেন পড়ে আছে, তা মন্ত্রণালয়ই ভালো বলতে পারবে।’

আসলে হাসপাতালটির দায়িত্ব কার, জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, মালিক মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। এটি বর্তমানে পরিত্যক্ত। হাসপাতাল পরিচালনার জন্য যে ব্যবস্থা, জনবল ও অর্থায়ন দরকার, তা নেই। জোগাড় করাও সম্ভব হয়নি। মন্ত্রী জানান, ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালের জমি ইজারা দিয়ে অথবা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য বহুতল ভবন করা যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে থাকা বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের পরিণতি ভালো হয়নি। ১৯৭২ সালে ট্রাস্টের অধীনে ৩২টি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দেওয়া হয়। এগুলো একে একে বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় আশির দশক থেকে। এখন শুধু পূর্ণিমা ফিলিং অ্যান্ড সার্ভিস স্টেশন, মিমি চকোলেট লিমিটেড ও ইস্টার্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ চালু রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী মনে করেন, ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালটি বছরের পর বছর ফেলে না রেখে সরকারের উচিত সংস্কার করা। তিনি বলেন, সংস্কার করে ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালকে অন্য কোনো একটি হাসপাতালের অংশ করা যেতে পারে অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।