৫টি রেখে ১৬টি বাতিলের চিন্তা

বিদ্যুৎ বিভাগ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের প্রস্তাব পাঠাবে। পেছনে তিন কারণ।

পরিবেশদূষণের কারণে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা রয়েছে। এখন সরকারও বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লানির্ভরতা থেকে সরে আসার চিন্তা করছে। বর্তমানে নির্মাণাধীন পাঁচটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রেখে বাকিগুলো পরিকল্পনা থেকে বাদ দেওয়ার কথা ভাবছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানায়, নির্মাণাধীন ৫টিসহ মোট ২১টি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকারের অনুমতি পেয়েছে। এগুলোর মোট উৎপাদনক্ষমতা ধরা হয়েছে ২৩ হাজার ২৩৬ মেগাওয়াট। সরকার যদি শুধু ৫টিকে পরিকল্পনায় রাখে, তাহলে বাদ পড়তে পারে ১৬টি। এর মধ্যে সরকারি সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগের ১১টি কেন্দ্র রয়েছে। বাকি ৫টি দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের।

কয়লাভিত্তিক এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কেন্দ্র নির্মাণে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা লাগে। যার অন্তত ৩০ শতাংশ অর্থ উদ্যোক্তার কাছে থাকতে হয়। কোনো কোনো উদ্যোক্তার সেই অর্থ নেই। এ কারণে তারা ব্যাংকঋণও জোগাড় করতে পারেননি।
নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী

সরকার কয়লাবিদ্যুৎ থেকে সরে আসছে মূলত তিনটি কারণে। প্রথমত, আমদানি করা কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা সামনে আসছে। কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে অর্থায়ন পাওয়া কঠিন। দ্বিতীয়ত, চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বেশি ধরা হয়েছে। ফলে নতুন নতুন কেন্দ্র নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তৃতীয়ত, অধিকাংশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ যথা সময়ে শুরুই হয়নি।

জানা গেছে, কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র বাতিলের সুপারিশ করে শিগগিরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রস্তাব পাঠাবে বিদ্যুৎ বিভাগ। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ২১ অক্টোবর মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ কম হলেও নির্মাণের অনুমতি পাওয়া অনেক কেন্দ্র কাজই শুরু করতে পারেনি। এ জন্য কয়লাভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে।

নির্মাণকাজ শুরু না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কয়লাভিত্তিক এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কেন্দ্র নির্মাণে প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা লাগে। যার অন্তত ৩০ শতাংশ অর্থ উদ্যোক্তার কাছে থাকতে হয়। কোনো কোনো উদ্যোক্তার সেই অর্থ নেই। এ কারণে তাঁরা ব্যাংকঋণও জোগাড় করতে পারেননি। এর বাইরে কয়লা পরিবহনসহ বেশ কিছু বিষয়ও রয়েছে।

সরকার যে পাঁচটি কেন্দ্রকে পরিকল্পনায় রাখছে, তার মধ্যে রয়েছে পায়রায় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও চীনের সিএমসির যৌথ অংশীদারত্বে ২ হাজার ৬৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটি। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) চার ইউনিটের ৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট এবং বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ মালিকানায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রও থাকছে পরিকল্পনায়।

এ ছাড়া বরগুনার আমতলিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইসোটেকের ৩০৭ মেগাওয়াট ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলমের ১ হাজার ২২৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। নির্মাণাধীন এই পাঁচটি কেন্দ্রের মোট উৎপাদনক্ষমতা ১০ হাজার ২৯১ মেগাওয়াট।

দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বেশি জোর দেওয়া শুরু হয় ২০১০ সালের পর থেকে। ওই বছর জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে সরকার বিদ্যুৎ খাতের ২০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা তৈরি করে। এতে মোট বিদ্যুতের অর্ধেক কয়লা দিয়ে উৎপাদনের কথা বলা হয়েছিল। ২০১৬ সালে এসে মহাপরিকল্পনা বদল করা হয়। বলা হয়, ২০৪১ সাল নাগাদ দেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে, যার ৩৫ শতাংশ হবে কয়লায়।

মহাপরিকল্পনায় বিদ্যুতের চাহিদার যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, তা–ও ঠিক হয়নি। বরং দেখা যাচ্ছে, উৎপাদন ক্ষমতার তুলনায় বিদ্যুতের চাহিদা বেশ কম। যেমন দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২০ হাজার ৩৮৩ মেগাওয়াট (স্থাপিত)। ২১ অক্টোবর চাহিদা ছিল সর্বোচ্চ ১০ হাজার মেগাওয়াটের মতো। কেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে বিপুল ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে সরকারকে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) হিসাবে, গত ছয় বছরে বিদ্যুৎ বিভাগ শুধু কেন্দ্রভাড়া দিয়েছে প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (জ্বালানি) অধ্যাপক ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, রামপাল ও পায়রা ছাড়া বাস্তবে কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। সরকার এ দুটি রেখে বাকি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে পারলে সেটা অত্যন্ত ভালো হবে। কারণ আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো অনেক কঠিন।

যেসব কেন্দ্রের অগ্রগতি নেই

মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, যেসব কেন্দ্রের কাজ এগোয়নি, সেগুলোই বাতিলের তালিকায় থাকবে। এর মধ্যে পটুয়াখালীর পায়রায় রুরাল পাওয়ার কোম্পানি ও চীনা প্রতষ্ঠান নরিনকোর যৌথ অংশীদারত্বের একটি কেন্দ্র রয়েছে। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ৯১৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। এরপর কেন্দ্রের আর অগ্রগতি নেই।

পটুয়াখালীতে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের (এপিএস) ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ৯৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে এ কেন্দ্রটির এখনো চুক্তি সই হয়নি। উত্তরবঙ্গ সুপার থারমাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নামের ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি প্রকল্প সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর্যায়ে রয়েছে।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘হাব’ (কেন্দ্র) করার চিন্তা করেছিল সরকার। মোট নয়টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল পরিকল্পনায়। এখন আটটির আর প্রয়োজনীয়তা দেখছে না মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে সিপিজিসিবিএল ও সিঙ্গাপুরের সেমকর্পের একটি, সিপিজিসিবিএল ও জাপানের সুমিতোমোর একটি এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগের চারটি কেন্দ্র থাকতে পারে বাতিলের তালিকায়।

দেশের তিনটি বেসরকারি কোম্পানিকে সাতটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয় সরকার। তবে এসব কেন্দ্রের কাজ তেমন একটা এগোয়নি। বিদ্যুৎ বিভাগের দুজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠান এখন কয়লার পরিবর্তে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চায়। তবে সরকার এ বিষয়ে এখনো ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে না।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ভবিষ্যতেও দেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা দাঁড়াবে, সে অনুযায়ী নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্র যথেষ্ট। তবে কয়লার বদলে এলএনজিভিত্তিক কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এলএনজির ব্যয় এখন কম থাকলেও ভবিষ্যতে বাড়তে পারে।