৫৪ বছর পর খোঁজ মিলল সিলেটের প্রথম দুই শহীদ মিনার নির্মাতার

এই শহীদ মিনার দুটির নকশাকার কে, তা জানা ছিল না এত দিন। এর পেছনের লোকটির কথা জানতে চায়নি কেউ।

সিলেট সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে সিলেট অঞ্চলের প্রথম শহীদ মিনার ‘৮ই’ প্রাঙ্গণে নকশাকার ও নির্মাতা হায়দার হোসেন চৌধুরী। ১৬ ফেব্রুয়ারি তোলা ছবি
আনিস মাহমুদ

ফটকের পাশে পাকা করা উঁচু ভূমি। চারদিক সীমানাবেষ্টিত। তাতে লোহা বাঁকা করে সিমেন্টের প্রলেপে তৈরি সংখ্যা ‘৮’ ও বাংলা অক্ষর ‘ই’। সাদামাটা এই স্থাপনার নাম ‘৮ই’। এটিই হচ্ছে সিলেটে ভাষা আন্দোলন ও ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। ১৯৬৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে সিলেট সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

তবে এই শহীদ মিনারের নকশাকার কে, তা জানা ছিল না এত দিন। নিজে হাতে নকশা করে ‘৮ই’ শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেছিলেন কলেজেরই একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। শুধু এ তথ্যটুকু কলেজে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু প্রাক্তন সেই শিক্ষার্থী কে, তিনি এখন কোথায়—এসব জানত না কেউ। প্রায় ৫৪ বছর পর ‘৮ই’ নকশাকার ও নির্মাতাকে খুঁজে বের করেছে সিলেটের ‘শিশু ও তরুণদের বুদ্ধি বিকাশ মঞ্চ—সম্পর্ক’ নামের একটি সংগঠন।

অন্তরালে থাকা এই মানুষটি হচ্ছেন সিলেট নগরীর জিন্দাবাজার এলাকার বাসিন্দা হায়দার হোসেন চৌধুরী (৭২)। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থাকলেও এখন রাজনীতিতে সক্রিয় নন। পেশায় ব্যবসায়ী মানুষটি জানিয়েছেন, পাকিস্তান শাসনামলের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় শহীদ মিনার নির্মাণ করে অন্তরালে ছিলেন। পরে কেউ জানতে চায়নি বলে তিনিও আর নিজ থেকে কাউকে জানাননি।

সম্পর্ক-এর প্রধান উদ্যোক্তা উত্তম কুমার সিনহাকে নিজ হাতে ইতিহাস তৈরি করা মানুষটাকে খুঁজে বের করার কৃতিত্ব দিতে হবে। তিনি গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনুসন্ধানকাজ শুরু করেন। এ বছরের ১০ জানুয়ারি এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হন তিনি। এখন প্রথম শহীদ মিনারের নকশাকার ও নির্মাতা হিসেবে হায়দার হোসেন চৌধুরীর স্বীকৃতির জন্য কাজ করছেন তিনি।

উত্তম কুমার বলেন, সিলেট অঞ্চলের শহীদ মিনার নির্মাণের ইতিহাস অনুসন্ধান নিয়ে কাজ করছিলেন তিনি। সিলেটের প্রথম শহীদ মিনার কোনটি, নকশাকার বা নির্মাতা কারা? এ প্রশ্ন রেখে গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে পোস্ট দেন তিনি। ঐতিহাসিক তথ্য, সিলেটের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে পরে সিলেট সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসের ‘৮ই’কে প্রথম ভাষা শহীদ মিনার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এটির নকশাকার ও নির্মাণ করেছিলেন কে—এ বিষয়ে কোনো তথ্য কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে সংরক্ষিত ছিল না। দেশে ও বিদেশে প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগের একপর্যায়ে হায়দার হোসেন চৌধুরীর নামটি খুঁজে পান।

মদনমোহন কলেজ ক্যাম্পাসে হায়দার হোসেন চৌধুরীর নকশায় শহীদ মিনার
প্রথম আলো

নির্মাণকালীন নকশাসহ বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে জানতে পারেন, হায়দার হোসেন চৌধুরী সিলেট সরকারি কলেজের পর ১৯৬৯ সালে সিলেটের মদনমোহন কলেজেও ‘৮ই’-এর আদলের আরেকটি শহীদ ‘৮’-এর নকশা করেছিলেন। সিলেট সরকারি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনার পর মদনমোহন কলেজ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি নেন। ওই সময় ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি মদনমোহন কলেজ ক্যাম্পাসে হায়দার নির্মাণ করেন সিলেটের দ্বিতীয় ভাষা শহীদ মিনার। সেই সময়ের নকশা-নথিপত্র সংগ্রহ করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে অনুসন্ধানকারী সংগঠন সম্পর্ক।

উত্তম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে যখন নিশ্চিত হই, তখন হায়দার হোসেন চৌধুরীর কাছে সংরক্ষিত সেই সময়ের নকশাসহ বিভিন্ন প্রমাণপত্র হাতে পাই। এসব ওই দুই কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হয়েছে। দুই শহীদ মিনারের নকশাকার ও নির্মাণকারী হিসেবে হায়দার হোসেন চৌধুরীকে কলেজ কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের স্বাক্ষরসংবলিত একটি আবেদনও করা হয়েছে।

সিলেট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মাজাহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘৮ই নামের ভাষা শহীদ মিনারটি কার নকশায় হয়েছে সেটি জানতাম না। তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

সিলেটের প্রথম দুই শহীদ মিনারের নকশা নিজ হাতে নির্মাণ করে অন্তরালে থাকলেও প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নীরবে সেখানে গিয়ে কিছু সময় কাটান হায়দার হোসেন চৌধুরী। উত্তম কুমার সিনহা গত ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকারি কলেজে ‘৮ই’ প্রাঙ্গণে নিয়ে যান তাঁকে। সেখানেই কথা হয় অন্তর্মুখী স্বভাবের হায়দার হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দুটো শহীদ মিনারের নকশা তৈরি, নির্মাণকাজ সম্পর্কে তাঁর বন্ধু-সহপাঠীরা জানতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ মারা গেছেন, কেউ প্রবাসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। হায়দার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমি আর রাজনীতিতে নেই। এ জন্য মনে হয় বিষয়টি আর জানার মধ্যে থাকেনি। তা ছাড়া কেউ জানতে চায়নি বলে আমিও নিজ থেকে আর কাউকে জানাইনি।’ এ কথায় কিছুটা যেন অভিযান ঝরে পড়ে হায়দার চৌধুরীর কণ্ঠে।

‘৮ই’-এর স্থাপত্য-ভাবনা সম্পর্কে হায়দার হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘রাজনৈতিক পোস্টার হাতে লেখায় পারদর্শী ছিলাম।আঁকার ঝোঁক ছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমার আঁকা ছবি ছাপা হতো। সেই থেকে দুটো শহীদ মিনার সাধারণভাবে তৈরির স্থাপত্য–ভাবনা স্থির করেছিলাম। সেই সময়টা বড় প্রতিকূল ছিল।২১ ফেব্রুয়ারি” তারিখটিএত বেশি পরিচিত ছিল যে এই নামে শহীদ স্মরণ তো দূরের কথা, উচ্চারণ করাটাও ঝুঁকির ছিল। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু এড়াতেআর বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহারের প্রচারে ৮ ফাল্গুন তারিখটি কৌশল করে প্রচার করতাম। এ জন্য আমরা তখন শহীদ মিনার না বলে ৮ই বলতাম।’