৫৫ হাজার রোহিঙ্গা প্রশ্নে আপাতসমাধানের কথা ভাবছে সরকার

মিয়ানমারের রাখাইনে দমন-পীড়নের শিকার হয়ে লাখো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

সৌদি আরবে অবস্থানরত প্রায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়া বা ফেরত পাঠানোর বিষয়ে এখনো অনড় দেশটি। এ অবস্থায় কিছু রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট দিয়ে হলেও একটা আপাতসুরাহা করা যায় কি না, তা নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে এসব রোহিঙ্গার পূর্ণাঙ্গ তালিকা চাওয়া হবে বলেও জানা গেছে।

সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিষয়টি সুরাহার জন্য সরকার সম্প্রতি একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি করেছে। ওই কমিটি গত সপ্তাহে তৃতীয় সভা করেছে। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে এ সমস্যা সমাধানের নানা উপায় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।

পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, ৫৫ হাজার রোহিঙ্গার বিষয়টি সুরাহার জন্য শেষ বৈঠকে বিভিন্ন সুপারিশ এসেছে। এসব সুপারিশের মধ্যে সৌদি কর্তৃপক্ষকে যুক্ত করে সমাধানের বিষয়টিও রয়েছে। বাংলাদেশ এ সমস্যার সমাধান চায়, এটাই মূল কথা। তবে এখন পর্যন্ত সৌদি কর্তৃপক্ষ পূর্ণাঙ্গ তালিকা না দেওয়ায় তাদের কাছে তালিকা চাওয়া হবে। ওই তালিকা পেলে সমস্যার সুরাহা সহজ হবে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একাধিক সরকারি কর্মকর্তা গত সপ্তাহে এই প্রতিবেদককে জানান, সৌদি কর্তৃপক্ষ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে অনড় রয়েছে। তাই সীমিত সংখ্যায় হলেও কিছু রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট দিয়ে ফেরত এনে আপাত একটা সুরাহা করা যায় কি না, তা নিয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। সর্বশেষ আলোচনায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে আলোচনার মাধ্যমে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে অনেকে মত দিয়েছেন। আলোচনায় এটাও এসেছে যে সৌদি কর্তৃপক্ষকে নিয়েই সমস্যার সমাধান করতে হবে। তাদের এই ধারণা দেওয়া জরুরি যে বাংলাদেশ সরকার এই সমস্যার সমাধানে আগ্রহী।

সৌদি কর্তৃপক্ষ হয়তো এসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর সঙ্গে কর্মী নেওয়ার বিষয়টি যুক্ত করতে পারে। সেটা করলে অন্যায় হবে। তাই বাংলাদেশ সরকারকে এ নিয়ে স্পষ্ট ও শক্ত অবস্থান নেওয়াটা অপরিহার্য।
সি আর আবরার, নির্বাহী পরিচালক, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরু

সমস্যা নিয়ে কথাবার্তা এক যুগ আগে
সৌদি আরব অতীতেও বিশেষ করে ২০০৭-০৮ এবং ২০০৯-১০ সালে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা আলোচনায় তুলেছিল। তবে তখন এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি দেশটি।

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর রিয়াদ সফরের সময় সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের বিষয়টি আলোচনায় তুলেছিলেন। তখন বাংলাদেশ বলেছিল, মিয়ানমারের নির্বাচনে অং সান সু চির ক্ষমতায় যাওয়ার পূর্বাভাস রয়েছে। মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদল হলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে।

বড় সংখ্যাটা মক্কার আশপাশের
২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশকে চিঠি দেয় সৌদি আরব। বিস্তারিতভাবে সবার নাম-পরিচয় না থাকলেও কোন সময় থেকে এরা সৌদি আরবে রয়েছে, কীভাবে গেছে আর কী ধরনের পাসপোর্ট ব্যবহার করেছে, তা চিঠিতে জানিয়েছে।

বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, সৌদি আরব যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে আনতে বলছে, তাদের বেশির ভাগের উপস্থিতি মক্কার আশপাশে। দেশটি এরই মধ্যে তিন লাখ রোহিঙ্গার ইকামা (কাজের অনুমতিপত্র) দিয়েছে, তাদের বেশির ভাগও মক্কা নগরী ও তার আশপাশে থাকেন। যে ৫৫ হাজারকে সৌদি আরব ফেরত পাঠাতে চায়, তাদের একটি অংশ ইকামাধারী রোহিঙ্গাদের পরিবারের সদস্য। তাঁদের অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে পাসপোর্ট নিয়ে গেছেন। আবার কেউ কেউ সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট নিয়েছেন কিংবা নবায়ন করেছেন।

২০১৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশকে চিঠি দেয় সৌদি আরব। বিস্তারিতভাবে সবার নাম-পরিচয় না থাকলেও কোন সময় থেকে এরা সৌদি আরবে রয়েছে, কীভাবে গেছে আর কী ধরনের পাসপোর্ট ব্যবহার করেছে, তা চিঠিতে জানিয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গত সেপ্টেম্বরে সৌদিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জাভেদ পাটোয়ারীর সঙ্গে আলোচনায় ৫৫ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার বিষয়টি আবার আলোচনায় তোলে সৌদি কর্তৃপক্ষ। তারা এ বিষয়ে অনড় মনোভাব দেখায়।

তবে অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার মনে করেন, বাংলাদেশের ওপর সৌদি আরবের এই চাপ একেবারেই অনায্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষ হয়তো এসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর সঙ্গে কর্মী নেওয়ার বিষয়টি যুক্ত করতে পারে। সেটা করলে অন্যায় হবে। তাই বাংলাদেশ সরকারকে এ নিয়ে স্পষ্ট ও শক্ত অবস্থান নেওয়াটা অপরিহার্য।