৭১-এ নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা বিশ্বের এখনো অজানা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ওপর চালানো নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র এখনো উঠে আসেনি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা এখনো বিশ্বের অজানা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা উইমেনস মিডিয়া সেন্টার পরিচালিত উইমেন আন্ডার সিজ প্রজেক্ট এ কথাগুলো বলছে। বিশ ও একুশ শতকে সংঘটিত গণহত্যা এবং যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে কীভাবে ধর্ষণ বা অন্যান্য যৌন নিপীড়নকে ব্যবহার করা হয়েছে, তা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করে এ প্রকল্পটি। অভিনেত্রী জেন ফন্ডা, রবিন মরগান ও গ্লোরিয়া স্টেইনেম ২০০৫ সালে উইমেনস মিডিয়া সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থা গণমাধ্যমে নারীর বিষয়টি তুলে ধরা। বর্তমানে এর প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে আছেন জুলি বার্টন।

উইমেন আন্ডার সিজ প্রজেক্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একাত্তরের যুদ্ধে দুই লাখ নন, অন্তত চার লাখ নারী সম্ভ্রমহানির শিকার হন।
চার লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির তথ্যটি প্রথম তুলে ধরেন ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড ফেডারেশনের ড. জেফরি ডেভিস। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস-এ (তৎকালীন সাপ্তাহিক সাময়িকী) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের নারী পুনর্বাসন জাতীয় বোর্ডের (ন্যাশনাল বোর্ড অব বাংলাদেশ উইমেনস রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম) সভাপতিকে ড. ডেভিস ওই সংখ্যা বলেছিলেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ড. ডেভিস পুরো বাংলাদেশ ঘুরে এ তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘একাত্তরে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের হত্যা ও ধর্ষণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রায় বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল। দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানবতাবিরোধী ওই অপরাধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে বিভিন্ন সংস্থাও যে সোচ্চার হচ্ছে, তারই একটি নমুনা আমরা এই প্রতিবেদনে পেলাম। সরকার ও নাগরিক সংগঠনগুলোর উচিত ওই সংস্থার প্রতিবেদনের দাবি এবং তথ্যগুলোকে আমলে নেওয়া এবং যুদ্ধাপরাধের নানা মাত্রা নিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন বাড়াতে এ ধরনের সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা।’ তবে সম্ভ্রমহানির শিকার নারীর সংখ্যা দুই লাখ না চার লাখ সেই বিতর্কে না গিয়ে মফিদুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশের লাখো নারী একাত্তরে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল, সেটা আবারও আন্তর্জাতিক পরিসরে গুরুত্ব দিয়ে সামনে আসাটাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’

মুক্তিযুদ্ধে দুই লাখ নন, অন্তত চার লাখ নারী সম্ভ্রমহানির শিকার হন —উইমেন আন্ডার সিজ প্রজেক্ট

এদিকে গতকাল নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে সাংবাদিক আনুশেহ হোসেন লিখেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা বহুলভাবে প্রশংসিত হলেও প্রায় চার লাখ নারী ও মেয়েশিশুর ধর্ষণ এবং নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি বিশ্বের কাছে প্রায় অজানা থেকে গেছে। ‘হোয়াই ইজ দ্য মাস সেক্সুয়ালাইজড ভায়োলেন্স অব বাংলাদেশেজ লিবারেশন ওয়ার বিইং ইগনরড’ শিরোনামে নিবন্ধে বলা হয়, একাত্তরের যুদ্ধে নারী নিগ্রহের মূল কারণ ছিল বাঙালি সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া এবং তাদের ক্ষমতাহীন করে তোলার একটি সুপরিকল্পিত চেষ্টা।
উইমেন আন্ডার সিজ প্রজেক্ট বলছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরপরই তৎকালীন সরকার যুদ্ধে দুই লাখ নারী এবং মেয়েশিশু ধর্ষণের শিকার হয় বলে জানায়। তবে এ সংখ্যা নিয়ে তখনই প্রশ্ন ওঠে। এ সংখ্যা আরও বেশি বলে একাধিক উৎস থেকে দাবি করা হয়।

প্রতিবেদনে গবেষক সুসান ব্রাউন মিলারকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, একাত্তরে হাজার হাজার বাঙালি নারীকে ধরে জোর করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের রাতের পর রাত ধর্ষণ করা হয়। একেবারে শিশুকন্যা থেকে ৭৫ বছরের বৃদ্ধাও এই নিগ্রহের হাত থেকে রেহাই পায়নি। প্রতিদিন ২ থেকে ৮০ জন পুরুষ নারীদের ধর্ষণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইয়াসমিন সাইকিয়া পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন থেকে বেঁচে যাওয়া এক নারীর সাক্ষাৎকার উদ্ধৃত করে বলেন, ক্রমাগত শারীরিক নির্যাতনের ফলে এক নারীর মৃত্যু হলে তাঁকে এবং আরেক নারীকে মৃত নারীর কবর খুঁড়তে এবং কবর দিতে বাধ্য করা হয়।
উইমেন আন্ডার সিজ প্রজেক্ট বলছে, যুদ্ধে নারীদের ওপর নিপীড়নের সংখ্যা হিসাব করা সব সময়ই খুব জটিল। আর বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি খুবই নেতিবাচক, সেখানে এই সংখ্যা নির্ণয় করাটা আরও জটিল।

শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কন্যা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মেঘনা গুহঠাকুরতা এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনের শুরুতে ধর্ষণকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়নি। পরে নারীবাদী ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আন্দোলনের ফলাফল হিসেবে ১৯৯৫ সালের বেইজিং সম্মেলনে ধর্ষণকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যুদ্ধাপরাধের অনুসন্ধানের সময় নারীদের ধর্ষণের বিষয়টিকে আমলে এনেছিল। তারা এ বিষয়ে অনেকের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু প্রসিকিউশনের সময় আমরা আলাদাভাবে ধর্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে দেখিনি।’ আন্তর্জাতিক পরিসরে যেহেতু আবারও বাংলাদেশের নারীদের ধর্ষণের বিষয়টিকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সামনে যে বিচারগুলো আছে, তাতে নারী ধর্ষণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবি জানান তিনি।