'এই কক্সবাজার! এই কুয়াকাটা!'

নাটোর শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছালেই শোনা যাবে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ট্যাক্সিচালকদের হাঁকডাক—‘এই কক্সবাজার! এই কুয়াকাটা!
প্রথমটা একটু চমকে যেতে হয়। পরে চমক ভাঙে। না, আসলে এখানে কক্সবাজারের ছিটেফোঁটাও নেই। আছে এক বিল, যা নাম কিনেছে দেশের ওই জনপ্রিয় সাগর সৈকতের।
নাটোর শহর থেকে আট কিলোমিটার উত্তরে পাটুলঘাটে চলনবিলের একটি অংশ হালতিবিল। বিলের মধ্যে কংক্রিটের তৈরি সাত কিলোমিটার সমতল সড়ক। ভারী বৃষ্টিতে সড়কটি তলিয়ে যায়। তখন চারদিকে শুধু পানি আর পানি। মাঝে দ্বীপের মতো কিছু গ্রামও চোখে পড়ে। ওই সময় ডিঙি নৌকায় বিলে ভেসে বেড়াতে গেলে মন ভরে যায়।
আজ শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে পাটুলঘাটে এই আনন্দ উপভোগ করতে এসেছেন অনেকেই। কেউবা এসেছেন ব্যক্তিগত গাড়িতে, কেউ অটোরিকশা, ট্যাক্সি, নছিমন বা ভটভটি ভাড়া করে।
সড়ক ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটছেন। দুই পাশ থেকে ঢেউ আছড়ে পড়ছে পথিকের পায়ে। যেন যত্ন করে পা ধুয়ে দিচ্ছে। চারদিকে স্রোতের কলকল শব্দ আর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের ডাক।
কুষ্টিয়া থেকে সপরিবারে এসেছেন মিনহাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘লোকমুখে প্রশংসা শুনে এখানে এসেছি। আসার পর এখানকার সৌন্দর্য দেখে অবাক লাগছে। মনে হচ্ছে, সত্যিই কক্সবাজার এসেছি।’
পাবনার মোলাডুলি গ্রামের দিনমজুর আব্বাছ আলী বলেন, ‘সারা বছর দিনমজুরি দিয়া খাই। আমাদের তো আর কক্সবাজার যাওয়ার সামর্থ্য নাই। তবে সামান্য খরচে যা দেখছি তা টেলিভিশনে দেখা কক্সবাজারের চেয়ে কম কী?’
কেমন খরচ হয়েছে—জানতে চাইলে আব্বাছ হাসিমুখে বলেন, ‘নাটোর শহর থেকে মাত্র ২০ টাকা ভাড়ায় অটোরিকশায় এখানে আইছি। আর অন্যদের সাথে নৌকার ভাড়া দিছি ৩০ টাকা। এই তো খরচ!’
স্বল্প আয়ের মানুষেরাই বেশি আসেন এখানে। সাধ্যের মধ্যে খুঁজে পেতে চান স্বস্তি ও সুখ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আসেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের শিক্ষার্থী শিউলি নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে বললেন, ‘আমি কক্সবাজারসহ অনেক জায়গায় ঘুরেছি। তার মধ্যে এখানকার সৌন্দর্যটা অন্য রকম। এখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অল্প খরচে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ঘোরা যায়।’
শিউলি বলেন, ‘আমি সারা দিন এখানে থাকব। এখানকার বড় সমস্যা, এখানে থাকা ও খাওয়ার ভালো হোটেল নেই। তাই হল থেকে আমরা খাবার করে এনেছি।’
নৌকায় উঠে শিউলি আরা যেমন খুশি, তেমনি খুশি মাঝি আব্বাছ মিয়াও। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হচ্ছে।
বাদাম বিক্রেতা শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুল করে এসে বিকেলে বাদাম, চানাচুর বিক্রি করে আমার মতো অন্তত ৫০ জন প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করে।’ তিনি বলেন, ‘বাইরের মানুষ আইসা আমাগোর ভালোই হইছে।’
পাটুলঘাট থেকে ১০ কিলোমিটার পূর্বে সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ সড়ক। এ সড়কটিও চলনবিলের তলি দিয়ে তৈরি। বিলের পানি বাড়লে রাস্তা ডুবে যায়। তখন নৌকা চলে। খোলা বাতাসে বিলের ঠান্ডা পানিতে পা ভেজাতে এখানেও ভিড় করেন মানুষ। বিকেলেই ভিড় বেশি হয়। ইচ্ছা করলে এখানেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকায় ঘুরে বেড়ানো যায়। স্থানীয়রা চলনবিলের এই অংশের নাম দিয়েছেন ‘কুয়াকাটা সৈকত’।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও নাটোর-৩ আসনের সাংসদ জুনাইদ আহমেদ, নাটোর-২ (সদর) আসনের সাংসদ শফিকুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান, পুলিশ সুপার বাসুদেব বণিক সম্প্রতি এই দুই এলাকা ঘুরে গেছেন। পর্যটকদের সুবিধা বাড়াতে তাঁরা বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান বলেন, স্বচ্ছন্দে বেড়ানোর জন্য জায়গা দুটির নিরাপত্তার দিকে নজর রাখা হয়েছে। বেড়াতে আসা নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিগগিরই থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা করার চেষ্টা চলছে।