'পশু বিপদে পড়লেও জীবন দিয়ে উদ্ধার করব'

‘যে দিন পুলিশে যোগদান করি, সেদিন থেকেই প্রতিজ্ঞা করি, যেন মানুষের উপকার করতে পারি এবং সারা জীবন যেন নিঃস্বার্থভাবে মানবসেবায় নিয়োজিত থাকতে পারি। আমার চোখের সামনে একটি পশু বিপদগ্রস্ত হলেও আমি জীবন দিয়ে তাঁকে উদ্ধার করব।’
কথাগুলো বলছিলেন দাউদকান্দি হাইওয়ে থানা-পুলিশের কনস্টেবল মো. পারভেজ মিয়া। গত শুক্রবার কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে ৪০ জন যাত্রী নিয়ে একটি বাস ডোবায় পড়ে যায়। আশপাশের লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাহুতাশ করছে আর এই এঁদো ডোবায় নামবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধান্বিত, তখন যাত্রীদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়েন পারভেজ মিয়া। বাসের জানালার কাচ ভেঙে ২৬ জনকে তিনি একাই উদ্ধার করেন।
শুধু সেদিনই নয়, গত ১৮ জুন রাত আড়াইটায় ঢাকা থেকে নোয়াখালীগামী রয়েল পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাসের যাত্রী লিজা আক্তারের একটি সমস্যার কারণে প্রবল রক্তক্ষরণ শুরু হয়। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। সেই মুহূর্তেও এগিয়ে এসেছিলেন বাসের যাত্রী এই পারভেজ মিয়া। ওই গৃহবধূকে মহাসড়কের পাশের সোনারগাঁও সেবা হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। রাত চারটায় লিজা সুস্থ হওয়ার পর পারভেজ নিজ থেকে হাসপাতালের বিল দিয়ে কর্মস্থলে ফেরেন।
লিজার স্বামী নোয়াখালী সদরের ব্যবসায়ী হারুণ-অর-রশিদ মোবাইলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ সদস্য পারভেজ মিয়া ওই দিন বাসে না থাকলে আমার স্ত্রীকে বাঁচানো সম্ভব ছিল না। কারণ, সেদিন আমার মানিব্যাগ হারিয়ে গিয়েছিল। সাময়িকভাবে হাসপাতালের খরচও তিনিই দিয়েছেন। তাঁর মতো মানুষই হয় না। এমন পুলিশ সদস্যকে হাজারবার শ্রদ্ধা জানাই।’
চার ভাইবোনের মধ্যে পারভেজ তৃতীয়। বড় দুই বোনের লেখাপড়া শেষে বিয়ে হয়েছে। আর ছোট ভাই মহিউদ্দিন এসএসসি পাস করার আগেই চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি নেন। বাবা মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম। আর মা গৃহিণী। তাঁদের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার হোসেনদী গ্রামে।
ছোটবেলায় বাবাকে দেখেছেন একটি বেসরকারি সংস্থায় ছোট্ট চাকরি করতে। আর সেই স্বল্প বেতন দিয়ে সৎভাবে জীবন যাপন করতে। তখন থেকেই মনে গেঁথে গেছে সততার বিষয়টি। স্বপ্ন দেখতেন পড়াশোনা করে প্রকৌশলী হবেন এবং মানুষের জন্য ভালো কিছু করবেন। ভর্তি হন মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার হোসেনদী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের কারিগরি শাখায় নবম শ্রেণিতে। ২০০৮ সালে এসএসসি (ভকেশনাল ইলেকট্রিক্যাল) পাস করেন। এরই মধ্যে দুই বোনের বিয়ের কারণে পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েন শুরু হয়। দুই বেলা ভাত জোটানো কঠিন হয়ে পড়ে। এর মধ্যে আবার বাড়িঘর কয়েকবার নদীভাঙনের কবলে পড়ে। তখন আশ্রয় নেন একই গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে। একপর্যায়ে পারভেজ চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি কারখানায় চাকরি নেন। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ব্যবসা শিক্ষা বিভাগে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু চাকরির কারণে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েও পাস করতে পারেননি।
এরপর আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়ায় হোটেল ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমাতে ভর্তি হন। দুই বছর লেখাপড়া করার পর একটি অসুবিধার কারণে দেশে ফিরে আসেন। গত বছরের আগস্টে পুলিশে যোগ দেন।
গত শুক্রবার বাস দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া এক যাত্রী মতলব দক্ষিণ উপজেলার গাবুয়া আচলচিলা গ্রামের আবদুর রব বলেন, ‘পুলিশ কনস্টেবল আমাদের যেভাবে উদ্ধার করলেন, তাঁর অবদানের কথা জীবনেও ভুলতে পারব না।’
দাউদকান্দি হাইওয়ে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, পারভেজ মিয়ার কর্তব্যপরায়ণতা ও সাহসিকতার জন্য কুমিল্লা রিজিয়ন হাইওয়ে পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ ১০ হাজার টাকা ও পেন্নাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেলিনা আক্তার পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেন। এ ছাড়া হাইওয়ে ডিআইজি আতিকুর রহমান ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।