'মাতৃছায়া'য় মমতা নেই

‘অমনোযোগী ছাত্রছাত্রী’দের জন্য পরিচালিত মাতৃছায়া আবাসিক স্কুলে সকাল, বিকেল ও রাত মিলে সাত থেকে আট ঘণ্টা কোচিং করতে হয় শিক্ষার্থীদের। এর বাইরে স্কুলের সময় তিন থেকে চার ঘণ্টা। এখানেই শেষ নয়, কেউ ক্লাসের পড়া দিতে ব্যর্থ হলে আরও তিন ঘণ্টা অতিরিক্ত ক্লাস। কপাল খারাপ হলে কোনো কোনো শিশুকে দিনে ১৩ থেকে ১৪ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন দেয়ালে অমনোযোগী ছাত্রছাত্রীদের জন্য মাতৃছায়া আবাসিক স্কুলের (আরেক জায়গায় লেখা আবাসিক ক্যাডেট স্কুল) যে বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে, এ অবস্থা সেই প্রতিষ্ঠানের। তবে দেয়ালে সাঁটানো পোস্টার, ব্যানার ও বিজ্ঞাপন দিতে যে খরচ, তাও নেওয়া হচ্ছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।
বিজ্ঞাপনে প্রতিষ্ঠানটির যে ঠিকানা দেওয়া আছে, সেই ঠিকানা ধরে শনিবার সন্ধ্যায় মগবাজারের মধুবাগে গিয়ে দেখা গেল, নামে মাতৃছায়া হলেও কোনো ধরনের স্নেহ ছাড়াই বড় হচ্ছে শিশুরা।
প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, ১৯৯০ সালে চালু হওয়া প্রতিষ্ঠানটিতে শিশুদের বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে শিশুদের সারাক্ষণ নজরদারিতে রাখার জন্য সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেখানে শিশুদের সাপ্তাহিক খাদ্যতালিকা আছে, পাঁচতলা ভবনে খাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। শিশুরা যে বেঞ্চে বসে পড়াশোনা করে, সেখানেই থালায় করে খাবার দেওয়া হয়। শিক্ষকদের সামনে বসে খাওয়া সবার জন্য বাধ্যতামূলক। একইভাবে শিশুদের বই রাখার জন্য আলাদা কোনো টেবিল নেই। বেঞ্চের নিচে একটু তাকের মতো করে বানানো, সেখানে বই রাখা হয়। ঘুমানোর জন্য আছে লোহার ছোটখাটে তেল চিটচিটে তোশক, বালিশ ও ময়লা বালিশ। ঘরের মধ্যেই ভেজা কাপড় মেলে দেওয়া। ঘরগুলো স্যাঁতসেঁতে। প্রতি ফ্লোরেই সিঁড়িতে আলাদা গেটে তালা লাগানো। প্রায় ৭০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাঁচজন মেয়েও আছে একটি ফ্লোরে। তবে প্রতিষ্ঠানটি প্রচার করছে, মেয়েদের জন্য তাদের আলাদা আবাসিক ব্যবস্থা আছে। শনিবার সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদক কয়েকজন অভিভাবককে দেখতে পান। তাঁরা সবাই তাঁদের ‘অমনোযোগী’ সন্তানকে ‘মানুষ’ বানানোর আশায় এসেছেন। আর অমনোযোগী খেতাব পাওয়া শিশুর কোনো কথাই কেউ গ্রাহ্য করছে না।
একজন অভিভাবক জানালেন, তাঁর সন্তানকে প্রথম একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করা হয়। সেখানে সে থাকতে চায়নি। তারপর একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করেন। কিন্তু সেখানেও যেতে চায় না। তাই এখানে এসেছেন। আরেকজন এসেছেন নিজের ছেলে ও ভাইয়ের ছেলেকে ভর্তি করতে। আরও কয়েকজন অপেক্ষমাণ আছেন।
প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা জানালেন, সপ্তম শ্রেণি থেকে মূলত শিক্ষার্থীরা অমনোযোগী হয়ে যায়। তাই এ ক্লাস থেকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এই অমনোযোগী সন্তানদের পেছনে বাবা-মায়ের খরচ কিন্তু মোটেই কম নয়। স্কুল এবং কোচিংয়ে একই শিক্ষক পড়াচ্ছেন। তার জন্য প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকা, সেশন চার্জ ২০ হাজার টাকা এবং মাসিক বেতন সাড়ে নয় হাজার টাকা। বার্ষিক অন্যান্য ফির মধ্যে আছে পরীক্ষার ফি ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং রমজান মাসের জন্য অতিরিক্ত ১ হাজার ৫০০ টাকা। আরও আছে আরবি পড়া বাবদ মাসিক খরচ ১ হাজার ৭০০ টাকা। পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাসিক সাড়ে ১০ হাজার টাকা বেতন। ইংরেজি শেখা এবং কম্পিউটার ক্লাসের কথা কাগজপত্রে আছে, বাস্তবে নেই।
পাঁচতলা ভবনেই শিশুদের থাকা, খাওয়া ও স্কুল। স্কুল বলতে একেকটি রুমে কয়েকজন বসে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ জনের বেশি হলে আলাদা সেকশন করা হয়। টিউটোরিয়াল অ্যানিমেশনের মাধ্যমে পড়ানোর দাবি করা হলেও রুমগুলোতে কয়েকটি বেঞ্চ ছাড়া আর কোনো কিছু দেখা যায়নি। কর্তৃপক্ষ দাবি করে, সরকারের কারিকুলাম অনুসারেই পড়ানো হচ্ছে। শিশুরা এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে অন্য একটি স্কুলের শিক্ষার্থী হিসেবে।
শিক্ষার্থীদের আবাসিক অবস্থা সরেজমিনে দেখতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক আবদুর রহমান এই প্রতিবেদককে সঙ্গে নিয়ে যান। তবে ছবি তোলা যাবে না বলে জানিয়ে দেন। তাঁর উপস্থিতিতে শিশুরা কথা বলতে চাচ্ছিল না। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এম এ সামাদ নিজেকে প্রিন্সিপাল বলে দাবি করেন। তবে তিনি এর আগে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তা বলেননি। তিনি বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান বলে দাবি করেন। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমনে চলে, আমরাও তেমনি চলি।’
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আশঙ্কা, এ ধরনের যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরো শিক্ষার পরিবেশ কলুষিত করছে। ঢালাও কোচিং চালাচ্ছে এবং কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কাই করছে না। আর প্রতিষ্ঠানে শিশুদের যে ধরনের পরিবেশে ও মানসিক নির্যাতন করে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদেরও লঙ্ঘন।’