
রাস্তার কোণে পসরা, তাতে কিছু ওষুধপথ্য ও চিকিৎসার যন্ত্রপাতি রাখা। লুঙ্গি পরা লোক নাড়ছিলেন চিকিৎসা-যন্ত্রপাতি। নিজেকে ‘ডাক্তার’ পরিচয় দিলেন। ডিগ্রি কী? জানতে চাইলে বলেন, ‘২৫ বছরের অভিজ্ঞতা’।
কোনো ধরনের চিকিৎসা সনদ নেই, মুখে বলা চিকিৎসকের ‘অভিজ্ঞতা’সম্পন্ন এই লোকের কাছে এলেন এক নারী। দাঁতের ব্যথায় কাতর তিনি। কিছুক্ষণ পর একটি ইনজেকশন পুশ করে হেঁচকা টানে একটি দাঁত উপড়ে আনলেন ‘ডাক্তার’। ‘ব্যথামুক্তি’র জন্য দাঁত উপড়ানোর কাজটি করে গর্ব করে দেখালেনও। ব্যথানাশক প্যারাসিটামল বড়ি ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করা হয় নারীকে।
সিলেট রেলস্টেশন এলাকার এ দৃশ্য নিত্যদিনের। রাস্তার পাশে ওই পসরার মালিক জহিরউদ্দিন। কিছুক্ষণ আগে যে কাজটি তিনি করলেন, সেটি ‘ডাক্তারি’ বলে জানালেন। গর্বের সুরে বলছিলেন, ‘এই যে আমি সার্জারিটা করলাম, সেটা বড় কোনো ডাক্তার করলে কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা গুনতে হইত। আমারে তো মাত্র ৫০০ টাকায় হইল! আসলে আমরা রাস্তায় বইলেও সস্তায় সস্তায় ঠিকমতোই ডাক্তারি করি।’
কেবল জহির নন, এ রকম আরও শতাধিক লোক নিজেদের চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে নগরের অলিগলি, বাসস্ট্যান্ড এলাকায় প্রায় প্রকাশ্যে চিকিৎসা চালাচ্ছেন। ‘সার্জারি-ডাক্তারি’ রাস্তায় বসে এক নিমেষেই তাঁদের চলে। এসব হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে সাধারণত চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে অসচেতন সহজ-সরল মানুষ, রিকশাচালক, ঠেলাওয়ালা ও বস্তিবাসী গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেন। কিন্তু হাতুড়ে চিকিৎসকদের অজ্ঞতা ও ভুল ওষুধ নির্বাচনের কারণে রোগীরা সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আরও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা এসব হাতুড়ে চিকিৎসকদের কাছে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরের দক্ষিণ সুরমা, কদমতলী, কুমারগাঁও, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা, সুবিদবাজার, পাঠানটোলা, চণ্ডীপুল, সুরমা পয়েন্ট, তালতলা এলাকায় হাতুড়ে চিকিৎসকেরা ফুটপাতে দিব্যি চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব চিকিৎসক মাথাব্যথা, জ্বর, সর্দি, কাশি, হাঁপানি রোগের চিকিৎসা থেকে শুরু করে দাঁত ফেলা, খতনা করানো, অর্শ ও গেজ নিরাময়সহ নানা জটিল রোগের অস্ত্রোপচার করছেন। চিকিৎসার যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে ওষুধপথ্যও রাস্তার উন্মুক্ত স্থানের পসরায় সাজানো থাকে। দরদাম করে সস্তায় কাজ করানো যায় বলে তাঁরা ‘রাস্তার ডাক্তার’ নামেও পরিচিত।
চলতি মাসের শুরুর দিকে নগরের শাহজালাল উপশহর এলাকায় লুৎফুর রহমান নামের এক হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে এক ব্যক্তি তাঁর শিশুর খতনা করান। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পরও রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় শিশুটিকে রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেন। ১৬ আগস্ট ওই শিশুটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ সামান্য টাকা খরচ করে জটিল সব রোগের চিকিৎসা ফুটপাতে হাতুড়ে চিকিৎসকদের কাছে যাচ্ছেন। কিন্তু না জেনে এসব চিকিৎসক সার্জারিসহ নানা জটিল রোগের ওষুধ দেওয়ায় রোগীরা উল্টো গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এতে পরে তাদের আরও অতিরিক্ত টাকা খরচ হচ্ছে। পাশাপাশি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে তারা। তাই রোগ দেখা দিলে হাতুড়ে চিকিৎসকদের কাছে না গিয়ে সরাসরি সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
লামাপাড়া এলাকার আবু লেইছ নামের এক ভুক্তভোগী জানান, মাত্র ১০০ টাকা খরচ করে তিনি মাস খানেক আগে এক হাতুড়ে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হয়ে ডান পাশের দুটো দাঁত ফেলেন। পরদিন থেকে তাঁর মাড়ি ভয়ানকভাবে ফুলে যায়। এরপর তিনি দ্রুত এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হন।
‘হাতুড়ে ডাক্তার’দের এমন প্রকাশ্য তৎপরতায়, বিশেষ করে পথচারী মানুষজন বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে বলে মনে করেন সিলেটের সিভিল সার্জন আজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘হাতুড়ে চিকিৎসকেরা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই রোগীদের ছোটখাটো সার্জারি করে ফেলায় মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।’
প্রকাশ্যে এমন তৎপরতায় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাতে পারেন বলে মনে করেন সিভিল সার্জন।
সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক তন্ময় ভট্টাচার্য বলেন, ‘নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকেরা অজ্ঞতার অভাবে হাতুড়ে চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হচ্ছে। অথচ নগরে বিনে পয়সায় চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো ওসমানী হাসপাতালের মতো বড় একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাই আমি আহ্বান জানাব—সাধারণ বা জটিল যে রোগেই আক্রান্ত হোন না কেন, সরকারি হাসপাতালে সেবা নিন।’