'৭১-এ গণহত্যার দায় অস্বীকার পাকিস্তানের

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলবের এক সপ্তাহ পর গতকাল সোমবার ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব করে পাকিস্তান ’৭১-এ গণহত্যার দায় অস্বীকার করেছে। এ সময় মানবতা–বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিচার এবং সাজা প্রশ্নে পাকিস্তানের বিরোধিতার বিষয়ে ঢাকার অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও অমূলক বলে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসলামাবাদ।
ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমী রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বেলা সাড়ে ১১টায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁকে তলব করা হয়। এ সময় তাঁর হাতে প্রতিবাদপত্র তুলে দেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া ও সার্ক বিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ফয়সাল।
ওই প্রতিবাদপত্রে গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া প্রতিবাদপত্রকে ‘ভিত্তিহীন দাবি’ আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এ ছাড়া গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধে মদদ দেওয়ার অভিযোগও পাকিস্তান প্রত্যাখ্যান করেছে।
ঢাকা ও ইসলামাবাদের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এ প্রতিবেদককে বলেছে, ১৯৭১-এ গণহত্যায় নিজেদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রত্যাখ্যানের সময় পাকিস্তানের কূটনীতিক গতকাল বেশ আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়েছেন। এ ছাড়া দায় এড়ানোর ক্ষেত্রে ঘুরেফিরে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সই হওয়া চুক্তির প্রসঙ্গ টেনেছেন পাকিস্তানের কূটনীতিক।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম রাতে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিবাদের জবাব দিয়ে পাকিস্তান আবারও ইতিহাস বিকৃত করছে। ’৭১-এ গণহত্যায় পাকিস্তানের কোনো দায় নেই বলাটা পুরোপুরি অসত্য। সবাই তা জানেন। তা ছাড়া ’৭৪-এর ত্রিপক্ষীয় চুক্তির প্রসঙ্গ টেনে পাকিস্তান যে সত্য ঘটনা বিকৃত করছে, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।
পাকিস্তান যা বলছে: পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এটা খুব দুঃখজনক যে বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের মানহানি করার চেষ্টা করছে। যদিও পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করে। পাকিস্তান বিশ্বাস করে, দুই দেশের জনগণ শুধু সম্পর্ক বজায় রাখতেই চায় না, বরং দুই দেশের বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় করতে চায়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশ সরকার দুই দেশের জনগণের এই ভাবাবেগকে সম্মান জানাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির কথা উল্লেখ করে পাকিস্তান বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘বাংলাদেশ সরকার মনে করছে, ওই চুক্তি ভুলভাবে ব্যাখ্যা করছে পাকিস্তান। ওই চুক্তি অনুযায়ী “বিচার না করার সিদ্ধান্তে” বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করে কারণ, আমরা বিশ্বাস করি পাকিস্তানের জনগণ বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাকতে চায়।’
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তিদের রায় কার্যকরের পর এ পর্যন্ত অন্তত চারবার ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার ও ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে তলব এবং প্রতিবাদপত্র পাঠিয়ে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের ঘটনায় পরদিন ২২ নভেম্বর পাকিস্তান সরকার গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা জানায়। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিবৃতিতে এই উদ্বেগ-নিন্দা জানানো হয়। পাশাপাশি দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন নেতা বক্তব্য-বিবৃতি দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৩ নভেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। গতকাল ইসলামাবাদ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারকে পাল্টা তলব করল।

২৩ নভেম্বর পাকিস্তানকে দেওয়া প্রতিবাদে বাংলাদেশ বলেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি নিয়ে ইসলামাবাদের প্রতিক্রিয়া একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রকাশ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা পাকিস্তান আবার স্বীকার করে নিচ্ছে। পাকিস্তানের এ অবস্থান একদিকে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যাকে অস্বীকার; অন্যদিকে চার দশক আগে ঘটে যাওয়া অপরাধের বিচার নিশ্চিত করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধে বাংলাদেশের প্রয়াসের অব্যাহত বিরোধিতার বহিঃপ্রকাশ।
প্রতিবাদপত্রে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সই হওয়া চুক্তি নিয়ে পাকিস্তান খণ্ডিত ব্যাখ্যা দিচ্ছে বলে তাদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এই অঞ্চলের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সুপ্রতিবেশী ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হচ্ছে চুক্তির মূলনীতি। ওই চুক্তিতে কখনোই মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যায় জড়িত এবং এর পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতদের দায়মুক্তি কিংবা বিচার থেকে রেহাই দেওয়ার কথা বলা হয়নি। অথচ চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের যে দায়িত্ব ছিল, সেটি পালনে পাকিস্তান ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পাকিস্তান তার দায় এড়াতে পারে না।

সাকা-মুজাহিদ নিয়ে পাকিস্তানের তৎপরতা অব্যাহত:

সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে বক্তৃতা-বিবৃতিসহ নানা কর্মসূচি চলছে।
ফাঁসি কার্যকরের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে গতকাল বাংলাদেশ সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিশেষ সহকারী ইরফান সিদ্দিকি। পাকিস্তানের সরকারি রেডিওর ওয়েবসাইটে ইরফান সিদ্দিকিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার নিজ দেশের নাগরিকদের ফাঁসি দিচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয়। তিনি অন্যকে বিপদগ্রস্ত করার নীতি থেকে সরে আসতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এর ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঘৃণার প্রাচীর সৃষ্টি হচ্ছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ বানিয়ে ফেলেছেন।
সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসির প্রতিবাদে গত রোববার লাহোরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। এতে পাকিস্তানের জামায়াতের আমির সিরাজুল হক বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা রোধে দেশপ্রেমিকেরা অনেক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। মানবতাবিরোধীদের ফাঁসির সমালোচনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কারাগারে এখন চার হাজার মানুষ বন্দী আছে। ২৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। কিন্তু এরপরও পাকিস্তান সরকার নীরব।
কর্মসূচিতে জামায়াতের অন্য বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছেন। তবে শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না। বাংলাদেশে যে অন্যায় চলছে, এর শেষ হবে।