অটোমেশন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়াং কিমের একটি মন্তব্য আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি বলেছিলেন, অটোমেশনের কারণে বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চাকরি বিপন্ন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বস্ত্র ও পাদুকাশিল্পকে সবচেয়ে ঝুঁকিতে ফেলবে অটোমেশন। আসলেই কি তাই ঘটবে? আসুন কয়েকটি ঘটনা থেকে পুরো বিষয়টির পর্যালোচনা করার চেষ্টা করি।
ঘটনা-১:
প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্বনামধন্য বস্ত্র প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রেমন্ডের ১৬টি কারখানায় রোবট ব্যবহার করতে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের খবর, রোবট ব্যবহারে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন।
ঘটনা-২:
বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস ২০১৬ সালে জুতা উৎপাদন কারখানাকে সম্পূর্ণ অটোমেটেড করে ফেলে। জার্মানিতে স্থাপিত স্পিড ফ্যাক্টরি নামের এক কারখানায় রোবটসহ থ্রি-ডি প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। আডিডাস জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশে আধুনিক কারখানা করার পরিকল্পনা করছে। সেখানে নতুন ধরনের রোবট ব্যবহার হবে। তাতে অ্যাডিডাস প্রায় ১০ লাখ পিছ স্পোর্টস শার্ট তৈরি করতে পারবে, যা বর্তমানের উৎপাদনক্ষমতার প্রায় ৩০০ শতাংশ বেশি। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয়, এসব কারখানায় উৎপাদন ব্যয়ও হবে অনেক কম।
ঘটনা-৩:
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান টেক্সপ্রসেস ২০১৭ সালের মে মাসে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে ‘ডিজিটাল টেক্সটাইল মাইক্রো ফ্যাক্টরি’ নামক একটি মেলা আয়োজন করে। সেখানে নকশা থেকে শুরু করে ফিনিশিং পর্যন্ত পোশাক প্রস্তুতের প্রতিটি ক্ষেত্রে অটোমেটেড প্রযুক্তি ছিল।
উপরিউক্ত ঘটনাগুলো থেকে এটি স্পষ্ট যে তৈরি পোশাকশিল্পে অটোমেশন বর্তমানে কোনো কল্পনা নয়, বাস্তবতা। অটোমেশনের এই ঢেউয়ের বিপরীতে চলা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে আমরা যখন দেশের পোশাকশিল্পে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, উৎপাদন সময় ও শ্রম কমানোর কথা আলোচনা করছি। অটোমেশন দ্বারাই এসব উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব।
বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ বস্ত্র ও পোশাকশিল্পে কাজ করছেন। তাঁদের অধিকাংশই তৃতীয় বিশ্বের বাসিন্দা এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৩ শতাংশই পোশাকশিল্প থেকে আসে। খাতটিতে কাজ করেন ৪০ লাখ শ্রমিক। তাঁরা মূলত কাপড় কেটে সেলাই করে তৈরি পোশাক প্রস্তুত করেন।
উৎপাদনপ্রক্রিয়ার ধাপগুলোতে অনেক দেশই অটোমেটেড প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। অটোমেশনের প্রভাবে লাখ লাখ শ্রমিক চাকরি হারালে বিপদ হবে। কারণ, তাদের কর্মসংস্থানের দেওয়ার মতো সক্ষম অন্য কোনো শিল্প এখনো গড়ে ওঠেনি দেশে। তাই বলে এই ভয় থেকে আমরা অটোমেশনকে এড়াতে পারি না। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। বিগত কয়েক বছর আগেও স্মার্টফোনের ব্যবহার এতটা জনপ্রিয় ছিল না। এখন প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমাদের হাত চলে যায় স্মার্টফোনে। এভাবেই আমাদের দিন শুরু হয়। প্রযুক্তির এই ব্যবহার কিন্তু আমরা এড়াতে পারি না।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প আর কত দিন সস্তা শ্রমের ওপরে টিকে থাকতে পারবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। তবে সস্তা শ্রমের অন্যতম কারণ প্রতিযোগী দেশগুলো থেকে আমাদের উৎপাদনশীলতা অনেক কম। অটোমেশনে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে। এতে শ্রমিকের মজুরিও বাড়বে। আবার অটোমেশন হলেই যে শ্রমিকের প্রয়োজন হবে না, তা নয়। অটো-কাটিং, থ্রিডি প্রিন্টিং, লেজার কাটিং, লেজার স্টোন-ওয়াশিংয়ে অটোমেশন ব্যবহার করার সুযোগ আছে। তবে পোশাক সেলাইয়ে এখন পর্যন্ত মানুষের হাতই শ্রেষ্ঠ। কারণ, এটি সৃজনশীল কাজ। এ বিবেচনায় অটোমেশন কখনোই আমাদের জন্য শত্রু নয়। বরং পোশাকশিল্পের অগ্রযাত্রায় এটি সহযোগী হতে পারে। এ জন্য শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে করে তারা অটোমেটেড যন্ত্রপাতি চালাতে পারে।
এখানে আমি বিল গেটসের একটি কথা উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, সরকারগুলোর উচিত অটোমেশনের প্রভাবে কর্মসংস্থান বিপন্ন হওয়ার ভয়ে ভীত না হয়ে সৃজনশীলভাবে ব্যবহার করা। তিনি ‘রোবট ট্যাক্স’ নামক একটি বিশেষ ধরনের ট্যাক্স প্রবর্তনের কথা বলেছেন। যেসব প্রতিষ্ঠান উৎপাদনের কাজে রোবট ব্যবহার করবে তারা এই ‘রোবট ট্যাক্স’ প্রদান করবে, যা সরকার ব্যয় করবে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে, যেন তারা চাকরিচ্যুত না হয়।
লেখক: মোস্তাফিজ উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড।