আড়ালেই থাকছে গৃহকর্মীর অবদান

শ্রমিকের সংখ্যা বেশি—এ রকম খাতগুলোর জন্য সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করবে সরকার। এ জন্য সম্ভাব্য খাতগুলোর তালিকা চাওয়া হয়েছে।

ইটভাটায় কাজ করা শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত কোনো মজুরি নেই। এ কারণে মালিকেরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ইটভাটা শ্রমিকদের মজুরি দেন। সিমেন্ট খাতেও ন্যূনতম মজুরি ঠিক করা নেই। এই খাতে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক জড়িত। এই খাতেও মজুরি নিয়ে চলছে অরাজকতা। সিরামিক খাতকেও শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী এই তিন খাতকে ন্যূনতম মজুরির আওতায় আনার প্রস্তাব উঠেছে।

ইটভাটা, সিমেন্ট, সিরামিকসহ মোট ১৪টি খাতে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে। এর মধ্যে নিম্নতম মজুরি বোর্ড সাতটি এবং শ্রম অধিদপ্তর আটটি নতুন খাতের তালিকা পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে।

তবে এর বাইরে আরও অনেক খাত আড়ালেই রয়ে গেছে, যেগুলোর জন্য সরকার এখনো নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করেনি। তাদের আইনি স্বীকৃতি যেমন নেই, তেমনি তাদের পক্ষে কথা বলারও কেউ নেই। তাদের জন্য কেউ উচ্চকিতও নয়। অথচ এসব পেশায় জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা অন্য অনেক পেশার চেয়ে বেশি। নির্দিষ্ট মানদণ্ড না থাকায় তাঁদের যাচ্ছেতাইভাবে মজুরি দিয়ে যাচ্ছেন মালিকেরা।

গৃহকর্মীদের উদাহরণই দেওয়া যাক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে অনুযায়ী সারা দেশে এখন ২৫ লাখ গৃহকর্মী আছেন। তাঁদের জন্য শুধু একটি নীতিমালা থাকলেও কোনো মজুরিকাঠামো নেই। গৃহকর্মীরা ঐক্যবদ্ধও নন। তাঁদের শ্রমিক ইউনিয়নও নেই। যার ফলে সরকারের নিম্নতম মজুরি হারে তাঁরা ঢুকতে পারছেন না। সে জন্য বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত ভাতা, ঈদ বোনাসসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তাঁরা।

জানতে চাইলে নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ প্রথম আলোকে বলেন, গৃহকর্মীদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে এখনো আইনি স্বীকৃতি নেই। শ্রম আইনে যদি এ পেশাকে ঢোকানো যায়, তখন তাঁদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা যাবে। তিনি আরও বলেন, গৃহকর্মীদের পক্ষে কথা বলার মতো মালিক প্রতিনিধি ও শ্রমিক প্রতিনিধি নেই। গৃহকর্মীদের মধ্যে ইউনিটিও নেই। ফলে গৃহকর্মীদের ন্যূনতম মজুরিতে অন্তর্ভুক্ত হতে দেরি হচ্ছে।

জানা গেছে, ফিলিপাইনসহ বিশ্বের অনেক দেশেই গৃহকর্মীদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা আছে। এমনকি ওই সব দেশে সপ্তাহে এক দিন সব গৃহকর্মী এক জায়গায় মিলিত হয়ে সময় কাটানোর সুযোগ পাচ্ছেন।

জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে গৃহকর্মী পেশা নিয়ে কেউ কাজ করেনি। তবে এখন শ্রম আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে গৃহকর্মী পেশা অন্তর্ভুক্তির আলোচনা চলছে।

শ্রম অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে ৪২টি শিল্পে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা আছে। তবে আরও অনেক উদীয়মান খাত আছে, যেগুলো ন্যূনতম মজুরিতে আসার দাবি রাখে। যেমন রাইড শেয়ারিং খাতে বর্তমানে বিপুলসংখ্যক মানুষ সম্পৃক্ত। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরাও ন্যূনতম মজুরির বাইরে রয়েছেন। তাঁরাও সংখ্যায় অনেক। বেসরকারি খাতে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, যাঁরা ন্যূনতম মজুরির বাইরে। এসব খাতেও মজুরি নির্ধারণ করা নিয়ে আলোচনা চলছে।

অন্যদিকে পুরোনো অনেক খাতকে ন্যূনতম মজুরি থেকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সারা দেশে আদালতপাড়া কিংবা জেলা প্রশাসক অফিসের সামনে একসময় টাইপ রাইটারের পেশা ছিল বেশ জনপ্রিয়। পেশাটির গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৮৩ সালে এ খাতের শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করে দেয় সরকার। কিন্তু কম্পিউটারের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্ব কমে যায় টাইপ রাইটারদের। শিল্পটি এখন অনেকটা বিলুপ্তির পথে। এই খাতকে ন্যূনতম মজুরি থেকে বাদ দিতে চায় সরকার।

সারা দেশে এ রকম অনেক পেশা আছে, যেগুলো বর্তমান বাস্তবতায় অনেকটা গুরুত্বহীন। অথচ এসব পেশায় সরকারঘোষিত ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা আছে। সিনেমা হল, পেট্রলপাম্প ও হোমিওপ্যাথি কারখানা। পেট্রলপাম্পের শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল সেই ১৯৮৭ সালে, যা এখনো চলছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন যেসব খাতে শ্রমিকের সংখ্যা বেশি, তাঁদের জন্য সর্বনিম্ন মজুরি হার নির্ধারণ করবে সরকার। নতুন খাতগুলোর তালিকা চাওয়া হয়েছে শ্রম অধিদপ্তর, নিম্নতম মজুরি বোর্ডসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার কাছে। সবার কাছ থেকে তালিকা পাওয়ার পর সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন খাতগুলোর জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হবে। আবার পুরোনো যেসব খাতের গুরুত্ব নেই, সেগুলো বাদ যাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে এমন আরও অনেক পেশা আছে, যেগুলো ন্যূনতম মজুরিতে অন্তর্ভুক্তের দাবি রাখে। বাসায় বসে যাঁরা বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন করেন, তাঁদের ন্যূনতম মজুরিতে আনা উচিত। এই পেশায় ২৫ লাখ শ্রমিক জড়িত। আবার রাস্তা বা ফুটপাতে যারা পণ্য বিক্রি করেন, তাঁদের সংখ্যা ১৫ লাখ।

শ্রম অধিদপ্তর বলছে, বর্তমানে যে ৪২টি খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ, ম্যাচ ইন্ডাস্ট্রিজ, বিড়ি, জাহাজভাঙা, ট্যানারি, অটোমোবাইল, প্লাস্টিক, পোশাক, নির্মাণশিল্প ও নিরাপত্তাকর্মী সেবা।

জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থানসচিব এহছানে এলাহী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে নতুন করে বেশ কিছু খাতের তালিকা আমাদের কাছে এসেছে। আমরা সেসব যাচাই–বাছাই করে নিম্নতম মজুরি বোর্ডে পাঠিয়ে দেব।’ তিনি আরও বলেন, গৃহকর্মীরাও একধরনের শ্রমিক। কিন্তু এই পেশাকে আইনি দুর্বলতার কারণে ন্যূনতম মজুরিতে আনার সুযোগ নেই। তবে গৃহকর্মীদের ন্যূনতম মজুরিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে কর্মশালার আয়োজন করা হবে।