ইইউর চেয়ে বেশি দামে টিকা কিনছে বাংলাদেশ

গরিব দেশগুলো এই টিকা না পেলে বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ অরক্ষিত থেকে যাবে। তাতে এই মহামারি আরও প্রলম্বিত হবে বলেই ধারণা করা যায়।

এএফপির ফাইল ছবি

অভাবনীয় গতিতে কোভিডের টিকা উদ্ভাবিত হয়েছে। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততার সঙ্গে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা মিললে কী ঘটতে পারে। তবে এই টিকা সমানভাবে সব দেশ না পেলে আখেরে লাভ হবে না।

এখন মূলত ধনী দেশগুলোর মানুষেরা টিকা পাচ্ছে। অনেকটা কাজও হচ্ছে। তবে গরিব দেশগুলো এই টিকা না পেলে বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ অরক্ষিত থেকে যাবে। তাতে এই মহামারি আরও প্রলম্বিত হবে বলেই ধারণা করা যায়। এর মধ্যে আবার ভাইরাসের নতুন রূপ সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে টিকাদানে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, ততটুকু আবার হুমকির মুখে পড়তে পারে।

এই পরিস্থিতিতে সমাধান হচ্ছে জনগণের টিকা নিয়ে আসা—সবাই পাবে এবং সবার নাগালের মধ্যে থাকবে। বর্তমানে টিকা প্রাপ্তি নিয়ে বৈষম্য বা একধরনের জাতিবিদ্বেষ তৈরি হচ্ছে, তা সমাধানের পথ করে দিতে পারে এই জনগণের টিকা। আমরা মনে করি, টিকার স্বল্পতা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং এই পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। কথা হচ্ছে, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের দাবি না থাকলে সারা বিশ্ব একসঙ্গে এই টিকা উৎপাদন করতে পারত। তাতে এ বছরের মধ্যেই বিশ্বের ৬০ ভাগ মানুষ এবং ২০২২ সালের মধ্যে যারা চায় তাদের সবাইকে এই টিকা দেওয়া সম্ভব ছিল—এক হিসাবে দেখা গেছে। কিন্তু ধনী দেশগুলো টিকা এবং ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রযুক্তি মজুত করে রাখায় এই স্বল্পতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে শুরু করে কানাডার মতো দেশের অনেক কোম্পানি এই টিকা বানাতে প্রস্তুত, কিন্তু অপেক্ষা শুধু সূত্রের। সে কারণে তারা কাজ শুরু করতে পারছে না। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এরা টিকা উৎপাদন করতে পারছে না। তারা টিকা বানাতে পারলে আরও অনেক মানুষ টিকা পেত এবং ধনী দেশগুলোর ওপর গরিবদের নির্ভরশীলতা কমত। স্বাস্থ্যগত এই জরুরি অবস্থায় এটা দরকার ছিল।

ওষুধ কোম্পানিগুলো অবশ্য বলছে যে তারা নিজেরাই উৎপাদন বাড়াতে পারবে। কিন্তু তাদের এই প্রতিশ্রুতির কথার ফানুসে পরিণত হয়েছে। ধনী দেশগুলোতেই তারা কথামতো সরবরাহ দিতে পারছে না। অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও জনসন অ্যান্ড জনসন উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এবং ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকায় সরবরাহ দিতে পারছে না। ফাইজার ও মডার্না মূলত মার্কিন বাজারে টিকা দিচ্ছে, অন্যরা পাচ্ছে অতি সামান্য।

এখানেই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের বিতর্ক চলে আসে। পেটেন্টের কারণে টিকার উৎপাদন বাড়ছে না, কারণ ওষুধ কোম্পানিগুলো টিকার সূত্র কিনে রেখেছে। উৎপাদনের ওপর তাদের একচেটিয়া অধিকার। যারা আবার তাদের কাছে থেকে লাইসেন্স কিনেছে, তারা উৎপাদন করতে পারবে, অন্যরা নয়। ফলে টিকার উৎপাদন ও বণ্টন এদের হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।

মূলত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) পৌরহিত্যে স্বাক্ষরিত ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস (ট্রিপস) চুক্তির আলোকে এই মেধাসম্পদ ব্যবস্থাপনা হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর এখন দাবি, বিশেষ পরিস্থিতিতে এই চুক্তির শর্ত শিথিল করা হোক। তারা বিশেষ ছাড় দেওয়ার অনুরোধ করেছে। অনেকে আবার যুক্তি দিচ্ছেন, ট্রিপসের মধ্যে এই শর্ত এমনিতেই আছে—যাদের উৎপাদনের সক্ষমতা আছে, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে লাইসেন্স দেওয়া। কিন্তু এর পরিসর অনেক ছোট এবং তা অনেক সময়সাপেক্ষও বটে। ফলে ছাড় দেওয়া হলে উন্নয়নশীল দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক কম খরচে টিকা উৎপাদন এবং বিতরণ করতে পারবে। অভিযোগ, এই দুঃসময়ে উন্নত দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো অনেক বেশি টাকা দাবি করছে। এতে গরিব দেশগুলোর বিরুদ্ধে ধনী দেশগুলো বাণিজ্য বিরোধের অভিযোগও আনতে পারবে না।

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ, উগান্ডা ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে বেশি দামে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কিনছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে তো অক্সফোর্ড আছে, অন্যান্য কোম্পানি আরও বেশি দাম নিচ্ছে। ফাইজার

বলে রেখেছে, পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে টিকার দাম বাড়ানো হবে। এরপর হয়তো দেখা যাবে, মডার্না ও জনসন অ্যান্ড জনসনও একই পথে হাঁটতে শুরু করেছে।

টিকার পাশাপাশি চিকিৎসাসামগ্রীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য—মেধাসম্পদের শর্ত শিথিল করা হোক। মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস—সবকিছুর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

কথা হলো, এই জ্ঞান তৈরিতে বিভিন্ন দেশের সরকার এত টাকা বিনিয়োগ করল, অথচ তা বেসরকারি খাতের হাতে থেকে গেল। ব্যাপারটা অনৈতিক। এই টাকা তো জনগণের কর থেকে এসেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই জ্ঞানের ওপর জনগণের কর্তৃত্ব থাকা উচিত।

ব্যাপারটা হলো, কোভিড-১৯ স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা। সারা বিশ্ব এর সঙ্গে লড়ছে। পরিস্থিতির উত্তরণে জ্ঞান বিতরণের নতুন সমাধান বের করতে হবে। তা নাহলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। খুঁজতে হবে সহযোগিতার নতুন দিক। সবচেয়ে বড় কথা, মানবতার ভিত অনেক গভীরে প্রোথিত করতে হবে।

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, লেখক তিনজন ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের সদস্য।