চার নারীর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প
ইমনের নামে মসলার ব্র্যান্ড
১৯ নভেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক নারী উদ্যোক্তা দিবস। উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রায় পিছিয়ে নেই এ দেশের নারীরাও। বিশেষ করে প্রযুক্তির কল্যাণে অনেক নারীই এখন ঘরে বসে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। নিজে কিছু করার স্বপ্ন থেকে কেউ যুক্ত হয়েছেন রন্ধনশিল্পের সঙ্গে। নানা পদের রান্নার রেসিপি দিয়ে আয় করছেন ঘরে বসে। আবার বিদেশের অভিজ্ঞতায় কেউ গড়ে তুলেছেন ভাগাভাগির অফিস বা কার্যালয় ব্যবসা। কেউ তৈরি করেছেন প্রশিক্ষণকেন্দ্র। আবার ঘরে বসেই মসলার জনপ্রিয় ব্র্যান্ডও তৈরি করে ফেলেছেন একজন। চার নারীর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প নিয়ে এবারের আয়োজন।
মাহমুদা সুলতানা ইমনরা চার বোন। তাঁদের বাবা ফজলুর রহমান ব্যাংকের চাকরি থেকে অবসর নেন। তারপর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার কাঁঠালবাগানে একটা ফোন–ফ্যাক্সের দোকানে ভাড়ায় ফ্রিজ বসিয়ে আদা, রসুন ও পেঁয়াজবাটার ব্যবসা শুরু করেন মাহমুদা। এটি ২০০৪ সালের কথা, তখনো ঢাকায় সেভাবে তৈরি মসলা পাওয়া যেত না। ফলে ব্যবসাও জমে ওঠে।
বাবা-মেয়ে মিলে মসলার ব্যবসাতেই থিতু হন। মাহমুদা বলেন, ‘কিছুদিন যেতেই আমরা বুঝে ফেলি, প্রথাগত হলুদ আর মরিচের গুঁড়া দিয়ে বাজারে টিকে থাকতে পারব না। আর সময়টাও এমন ছিল যে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ তখন বাড়ছিল। তাই আমরা আরেকটু বিশেষায়িত মসলার দিকে যাই। একে একে নতুন নতুন তৈরি মসলা যোগ করি বিক্রির তালিকায়। ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ করে মসলা ভাঙানোর মেশিন বসাই। ওই মেশিনে বিভিন্ন মসলার গুঁড়া তৈরি করতে থাকি। মোটামুটি বাজারও পেয়ে যাই।’
প্রথম ১০ বছর বাবা-মেয়ের মসলার কারবার মোটামুটি ভালোই যায়। ঘুরে ঘুরে সুপারশপগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। এতে বিক্রিও বাড়তে থাকে। অন্যদিকে বাজারে তত দিনে প্রতিযোগিতাও বাড়ছিল। এরই মধ্যে বাবা ফজলুর রহমান বার্ধক্যের কারণে কাজ থেকে অবসর নেন। তখন মাহমুদা ব্যবসায়ের অংশীদার করেন তাঁর জীবনসঙ্গীকে। সেই সঙ্গে শুরু হয় তাঁর জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।
সম্প্রতি মাহমুদা তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিটিএমইইর রাজধানীর মেরুল বাড্ডার অফিসে বসে প্রথম আলোকে তাঁর ব্যবসাজীবনের গল্প শোনান। জানালেন, বাবা–মেয়ের ব্যবসায় ভালোই আয় হতো। বছরে প্রায় ১০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করতেন তাঁরা। নতুন অংশীদার হিসেবে স্বামী যুক্ত হওয়ায় ঋণ নিয়ে ব্যবসা কিছুটা বাড়ান। কিন্তু ব্যবসায় উন্নতি হচ্ছিল না। মাহমুদা বলেন, ‘আমি টের পেতে থাকি, অনেক কাজ করার পরও আমাদের আয় কমছে। মিলছে না আয়–ব্যয়ের হিসাব।’
নিজের হাতে আবার দায়িত্ব তুলে নেন মাহমুদা। ধীরে ধীরে বন্ধ করতে থাকেন ব্যবসায় তৈরি হওয়া ছিদ্রগুলো। এতে বড় সমস্যা তৈরি হয় তাঁদের দাম্পত্য সম্পর্কে। অবশেষে ২০১৮ সালে স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে। মাহমুদা জানান, বিচ্ছেদের পর তিনি বুঝতে পারেন, সব ঋণের ভার পড়েছে তাঁর ঘাড়ে। ব্যবসা আর সম্পদ তাঁর নাগালে নেই।
প্রথমবার যখন ব্যবসা শুরু করেছিলেন, পুঁজি ছিল ৫০ হাজার টাকা। এবার তাঁর হাতে আর কোনো পুঁজি নেই। উপরন্তু বাজারে ১৮ লাখ টাকা দেনা। তিন সন্তানের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। মামলার কারণে কারখানাও তাঁর দখলে নেই। মাহমুদার বাবা ফজলুর রহমান তখনো জীবিত ছিলেন। মাহমুদা বলেন, ‘বাবা আমাকে শুধু একটা কথা বলেছিলেন, সব চলে গেলেও তোমার অভিজ্ঞতা কেউ নিয়ে যেতে পারেনি। তুমি আবার শুরু করো।’
অভিজ্ঞতা আর জমানো কিছু টাকা পুঁজি নিয়ে ২০১৮ সালেই মাহমুদা আবার শুরু করেন। সঙ্গে কর্মচারী মাত্র একজন। তবে দুই–আড়াই বছরের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ান মাহমুদা। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠান বিটিএমইই ১০০ ধরনের তৈরি মসলার মিশ্রণ ও ভেষজ গুঁড়া উৎপাদন ও বিক্রি করে। নিজের ডাক নামেই রেখেছেন ব্র্যান্ডের নাম ‘ইমন’। মাহমুদা সুলতানা জানান, নিজের ‘ইমন’ ব্র্যান্ডের পাশাপাশি সুপারশপ স্বপ্নের নিজস্ব ব্র্যান্ডের জন্যও তিনি মসলার মিশ্রণ তৈরি করেন। অনলাইনভিত্তিক দেশীয় খাদ্যপণ্যের সাইট খাস ফুডও তাঁর কাছ থেকে মসলা নেয়।
মাহমুদা জানান, তাঁর কারখানায় এখন কাজ করেন ১৬ কর্মচারী। কাজের বড় ফরমাশ এলে বাইরে থেকে চুক্তি ভিত্তিতে কিছু কর্মী নিয়ে আসেন। বাজারে নতুন নতুন মসলার মিশ্রণ আনার চেষ্টা করেন। যেমন গত ঈদুল আজহার সময় এনেছেন নিহারি ও গরুর ভুঁড়ি রান্নার রেডি মসলা। সেই সঙ্গে এনেছেন মিষ্টি তৈরির মিশ্রণও। এখন বছরে তাঁর বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৮০ লাখ টাকার মতো।
মাহমুদা বলেন, ‘ছোট ব্যবসায়ীর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ব্যবসা বিস্তারে কোনো পুঁজি পাওয়া যায় না। বাজারে থাকলেও পুঁজির অভাবে সুযোগ নেওয়া যায় না। নিজের আয় থেকেই একটু একটু করে বড় করছি ব্যবসাটাকে। শোধ করছি আগের ঋণও।’
আরও এগিয়ে যেতে চান মাহমুদা সুলতানা। বলেন, ‘হয়তো কচ্ছপের গতিতে এগোব, তবে দৌড় প্রতিযোগিতায় কিন্তু আমিই জয়ী হব। কারণ, খুব শিগগির দেশের বাইরেও বিভিন্ন মসলার মিশ্রণ রপ্তানি করব।’