ছোট উদ্যোক্তারাই অর্থনীতির প্রাণ

ছোট, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প বিশ্ব এমএসএমই দিবস আজ। বিশ্বজুড়েই এসএমই খাতকে বলা হয় অর্থনীতির প্রাণ।তাই বিশ্বের দেশে দেশে এ খাতের উন্নয়নে নেওয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। তবে এ খাতের উদ্যোক্তারা ভুগছেন অর্থায়ন সমস্যায়।

ছোট কলকারখানা স্থাপনেই এখন উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বেশি। বদৌলতে দেশে দিন দিন ছোট কলকারখানার সংখ্যা বাড়ছে। গত এক দশকে এ ধরনের কারখানার সংখ্যা বেড়েছে সাড়ে সাত হাজারের বেশি। উদ্যোক্তাদের ছোট কলকারখানা গড়ে তোলার দিকে ঝোঁকার অন্যতম কারণ হলো, এতে তুলনামূলক কম বিনিয়োগ লাগে। বড় বড় শিল্প এলাকার বাইরে গিয়েও অল্প পুঁজিতে কারখানা স্থাপন করা যায়। এভাবেই ছোট কারখানাগুলো এখন হয়ে উঠেছে অর্থনীতির প্রাণ।

ব্যাংকঋণ সহজলভ্য না হলেও নিজের জমানো টাকা, স্বামী বা স্ত্রী কিংবা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধারকর্জ নিয়েই ছোট কলকারখানায় বিনিয়োগ করেন ছোট ও নবীন উদ্যোক্তারা।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি ‘উৎপাদন শিল্প জরিপ’–এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর আগে ২০১৯ সালে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত এক দশকে দেশে ছোট কারখানার সংখ্যা বেড়েছে ৭ হাজার ৬৪০টি। ফলে সারা দেশে বর্তমানে ছোট কারখানা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৩০৬টি। দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে–ছিটিয়ে গড়ে ওঠা এসব কারখানায় পোশাক, পাট ও পাটজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পণ্য, বেকারি পণ্য উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া রাইস মিল তথা চালকলসহ নানা ধরনের ছোট কারখানাও রয়েছে অনেক।

শ্রমিকের সংখ্যা দিয়ে শিল্পকারখানার সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বিবিএস। শ্রমিকসংখ্যা ২৫০ জনের বেশি হলে সেটাকে ভারী শিল্প বলা হয়। আর শ্রমিক ১০০-এর বেশি ও ২৫০–এর কম হলে সেটাকে মাঝারি শিল্প এবং ২৫ জনের বেশি ও ১০০ জনের কম হলে ছোট শিল্প বলে। এ ছাড়া কারখানায় শ্রমিকসংখ্যা ২৫ জনের কম থাকলে সেটাকে অতিক্ষুদ্র শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে বিবিএস। সংস্থাটির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন মাঝারি শিল্পকারখানা আছে ৩ হাজার ১৭৮টি। অবশ্য এক দশকের ব্যবধানে এ ধরনের কারখানার সংখ্যা প্রায় তিন হাজার কমেছে।

দেশে বর্তমানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) কারখানার সংখ্যা সাড়ে ২৬ হাজার। আর এখন ভারী শিল্প আছে প্রায় ২ হাজার ৮৫৬টি।

সারা দেশে শিল্পকারখানায় প্রায় ৫৪ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে সাড়ে ১০ লাখ শ্রমিক ছোট ছোট কারখানায় ও পাঁচ লাখ মাঝারি শিল্পে কাজ করেন। বাকি প্রায় ৩৬ লাখ শ্রমিক বড় শিল্পে কাজ করেন, যার সিংহভাগই পোশাকশ্রমিক।

বিবিএস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এসএমই খাতে ৬৩ হাজার ৮৪১ কোটি টাকার সম্পদ আছে। আর প্রতিবছর এই খাত থেকে অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন হয় ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। ছোট ও মাঝারি শিল্পোউদ্যোক্তারা দেশের চাহিদা মেটান, আবার বিদেশেও পণ্য রপ্তানি করেন। অন্যদিকে এসএমই কারখানাগুলো বড় শিল্পের সংযোগ শিল্প হিসেবে কাজ করে থাকে।

গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। এই সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এসএমসই খাত প্রসারে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, হালকা প্রকৌশলসহ ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি হলো। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা শিল্প খাতের প্রাণ। তাই তাঁদের জন্য ব্যাংকঋণসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত
করতে হবে।

ব্যাংকঋণ পাওয়া বড় সমস্যা

ছোট উদ্যোক্তাদের নানা বাধা পেরিয়ে তবেই এগোতে হয়। এর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ২০১৭ সালে বাড্ডায় তিনটি মেশিন বসিয়ে একটি ছোট কারখানা তৈরি করেন ইশরাত জাহান চৌধুরী। গত পাঁচ বছরে তিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন। করোনার মতো ধাক্কাও তাঁকে থামাতে পারেনি। তুলিকা ইকো লিমিটেড নামের এই কারখানা থেকে বিদেশে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেন তিনি। এই কারখানায় ৫০-৬০ জন কর্মী রয়েছেন। ক্রমশ কাজের পরিধি বাড়ছে। সে জন্য বাড়তি কিছু সুবিধা দরকার।

এ বিষয়ে তুলিকার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইশরাত জাহান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ছোট ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধা আরও বাড়ানো উচিত। কারণ, জামানত দিতে না পারলে ব্যাংকঋণ পাওয়া যায় না। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে জামানত দেওয়া কঠিন। তাই তাঁদের জন্য ব্যাংকঋণ পাওয়া দুষ্কর। যে কারণে ছোটরা আর বড় হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পই একটি দেশের অর্থনীতির প্রাণ। এ জন্য তাদের এগিয়ে আসার সুযোগ দিতে হবে।

অর্ধেকেরই ব্যবসা নিজের টাকায়

ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড়—এই তিন ধরনের শিল্পকারখানার মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের অর্ধেককেই নিজের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। বিবিএস বলছে, দেশের ক্ষুদ্র শিল্পকারখানার ৫৭ শতাংশের ব্যাংকঋণ আছে। এর মানে, ৪৩ শতাংশ কারখানার মালিককে নিজের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। অন্যদিকে মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ নিজের টাকা বিনিয়োগ করেছেন। বাকিদের ব্যাংকঋণ আছে। আর বড় শিল্পোউদ্যোক্তাদের প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনেরই ব্যাংকঋণ আছে।

ছোটরা কেন ব্যাংকঋণ পান না—এ বিষয়ে একজন ছোট শিল্পকারখানার মালিক জানান, কোভিডের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য শ্লথ হয়ে যায়। তখন তাঁর প্রতিষ্ঠান সরকারি দরপত্রে অংশ নিয়ে চালের বস্তা বানিয়ে সরকারকে সরবরাহের ব্যবসায় নামে। গত বছর তিনি একবার আড়াই লাখ পিস চালের বস্তা সরবরাহের ক্রয়াদেশ পান। এ জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা দরকার হয়। কিন্তু কোনো ব্যাংক তাঁকে তিন মাসের জন্য এই টাকা ঋণ দেয়নি। সরকারি ক্রয়াদেশের বিপরীতে ঋণের জন্য আবেদন করলেও ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়ে দেন, জমি বা ফ্ল্যাট এ ধরনের সম্পদ জামানত না রাখলে ঋণ মিলবে না। এভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা পিছিয়ে পড়েন এবং নিজের টাকা না থাকলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা করা কঠিন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই

গত দুই বছরে করোনা প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। এ সময় তাঁদের যেমন বিক্রি ও আয় কমেছে তেমনি লোকবলও ছাঁটাই করতে হয়েছে। বহু ছোট উদ্যোক্তা কারখানা বন্ধ করতে কিংবা উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছেন।

গত বছর গবেষণা সংস্থা বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের এক যৌথ জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালে ছোট ব্যবসায়ীদের বিক্রি করোনার আগের চেয়ে ৮৬ শতাংশ কমেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আয় কমেছিল ৬৬ শতাংশ।

অবশ্য করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। এই প্রণোদনার অর্থ দেয় ব্যাংকগুলো। সুদের অর্ধেক সরকার দেয়। কিন্তু এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা সেই প্রণোদনা সুবিধা নিতে পারেননি।

করোনা শুরুর এক বছর পর জরিপ করেছিল আরেক গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। এ গবেষণায় বলা হয়, মাঝারি শিল্পের ২৮ শতাংশ ও ক্ষুদ্র শিল্পের ১০ শতাংশ উদ্যোক্তা প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন। জানা গেছে, শুধু তাঁরাই প্রণোদনা–সুবিধা পেয়েছেন, যাঁদের আগে থেকেই ব্যাংকঋণ ছিল।