বোতলজাত পানির ব্যবসা জনপ্রিয়তা পায় তাঁর হাত ধরেই

এম এ হাসেম

শুরুটা করেছিলেন তামাক পণ্যের ব্যবসা দিয়ে। এরপর শুরু করেন আমদানি বাণিজ্য। শুরুর ব্যবসার সফলতায় একের পর এক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন সদ্য প্রয়াত শিল্পোদ্যোক্তা ও পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এম এ হাসেম। নানা খাতের ব্যবসার পাশাপাশি ব্যাংক, বিমা, বেসরকারি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ও গড়ে তোলেন। এম এ হাসেমের গড়ে তোলা ৬০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

প্রয়াত শিল্পপতি এম এ হাসেমের হাত ধরেই এ দেশে বোতলজাত পানির ব্যবসা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর প্রতিষ্ঠানের ‘মাম’ বোতলের পানি এখনো বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়। অথচ তিনি যখন এ ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তখন অনেকে এটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এম এ হাসেম ছিলেন তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল। পানির ব্যবসা শুরুর আগে সবাই বলেছিলেন, এ দেশের মানুষ আর যা–ই হোক, পানি কিনে খাবে না। কিন্তু ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। মানুষ যে ব্যবসা করতে সাহস দেখাতেন না, সেখানেই সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতেন তিনি। আর তাতেই পেয়েছেন ব্যবসায়িক সফলতা।

সফল এ ব্যবসায়ী গত বুধবার দিবাগত রাতে হার মেনেছেন করোনাভাইরাসের কাছে। গতকাল তাঁকে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।

এম এ হাসেমের হাত ধরেই এ দেশে বোতলজাত পানির ব্যবসা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর প্রতিষ্ঠানের ‘মাম’ বোতলের পানি এখনো বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়।

শিল্পোদ্যোক্তা এম এ হাসেম সম্পর্কে জানতে চাইলে অগ্রণী ও সাউথইস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার প্রথম আলোকে বলেন,‌ ‘তিনি যে পরিমাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তা ছিল অবাক করার মতো। এ দেশের খুব কম উদ্যোক্তাই আছেন, যাঁরা এত বেশি খাতে বিনিয়োগ করতে পেরেছেন। দেশে কর্মসংস্থান তৈরিতে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। সব সময় অন্যের উপকার করতেন। ব্যাংকারদের বেশ সম্মান করতেন। আশা করছি, পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর সেই ধারা অনুসরণ করবেন।’

পারটেক্স গ্রুপসংশ্লিষ্ট ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এম এ হাসেম ১৯৫৯ সালে তামাক পণ্যের ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৬০-এর দশকে এসে চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন মেসার্স হাসেম করপোরেশন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই করপোরেশনের অধীনে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি সিমেন্ট, ইস্পাত আমদানি শুরু করেন। এরপর দেশেই বিভিন্ন কারখানা গড়ে তোলেন। এভাবেই গড়ে ওঠে পারটেক্স গ্রুপ।

শিল্পকারখানার পাশাপাশি এম এ হাসেম বেসরকারি খাতের সিটি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন। এর বাইরে জনতা ইনস্যুরেন্স, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। এসব প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পদে থেকে নেতৃত্বও দিয়েছেন। এম এ হাসেম পারটেক্স গ্রুপের ব্যবসা ছড়িয়েছেন আবাসন, আমদানি-রপ্তানি, পার্টিকেল বোর্ড, ইস্পাত, প্লাস্টিক, ভোগ্যপণ্য, ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন খাতে।

তিনি যে পরিমাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তা ছিল অবাক করার মতো। এ দেশের খুব কম উদ্যোক্তাই আছেন, যাঁরা এত বেশি খাতে বিনিয়োগ করতে পেরেছেন।
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার, সাবেক ব্যাংকার

২০০৯ সালে পাঁচ সন্তানের মধ্যে ব্যবসা ভাগাভাগি করে দেন তিনি। ফলে গড়ে ওঠে পারটেক্স স্টার ও আম্বার গ্রুপ। এম এ হাসেম তাঁর দুই ছেলে আজিজ আল মাসুদ ও আশফাক আজিজ রুবেলকে নিয়ে পারটেক্স গ্রুপ দেখভাল করতেন। এই গ্রুপের অধীনে রয়েছে মাম পানি, কোমল পানীয় আরসি কোলা, পারটেক্স পেপার, পারটেক্স জুটসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

এম এ হাসেমের স্ত্রী সুলতানা হাসেম, বড় ছেলে আজিজ আল কায়সার ও আজিজ আল মাহমুদ মিলে দেখভাল করেন পারটেক্স স্টার গ্রুপ। এ গ্রুপের অধীনে রয়েছে খাদ্যপণ্য ব্র্যান্ড ড্যানিশ, পারটেক্স বোর্ড, পিভিসি পাইপ, হাউজিংসহ নানা প্রতিষ্ঠান। অপর ছেলে শওকত আজিজ রাসেল দেখভাল করছেন আম্বার গ্রুপ। গাজীপুরের ভাওয়াল রিসোর্ট এই গ্রুপের অধীনে।

অভিমত

মীর নাসির হোসেন

নিজের চেষ্টা ও মেধায়

সফল এক উদ্যোক্তা

মীর নাসির হোসেন, সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর দেশের যে কয়েকজন উদ্যোক্তা শিল্পকারখানা করতে এগিয়ে এসেছিলেন এবং তাতে সফল হয়েছেন, তাঁদেরই একজন এম এ হাসেম। খুব ছোট থেকে নিজের চেষ্টা ও মেধায় বড় হওয়া একজন সফল উদ্যোক্তার উদাহরণ ছিলেন তিনি। যে ব্যবসায় হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন। এর ফলে তিনি অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তাতে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশে এখনো বড় সমস্যা কর্মসংস্থানের ঘাটতি। সেই ঘাটতি কিছুটা হলেও দূর করতে ভূমিকা রেখেছেন এম এ হাসেম ও তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলো।

একজন সফল শিল্পোদ্যোক্তা হতে হলে সবচেয়ে বড় যে গুণ থাকতে হয়, তা হলো দ্রুততম সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। সেই কাজ বরাবরই সফলতার সঙ্গে করতে পারতেন তিনি। সাহস করে ঝুঁকি নিয়ে নতুন নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন, সফলও হয়েছেন। শুধু শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়েই সফল হননি, অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করেও সফল হয়েছেন। তিনি ছিলেন বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। সেই বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এখন অন্যতম। এম এ হাসেম তাঁর গড়া প্রতিষ্ঠানে যে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে গেছেন, আমি আশা করব তাঁর ছেলেরা সেটা আরও বহু দূর এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

অভিমত

আবুল কাসেম খান

যে ব্যবসায় হাত দিয়েছেন

সেখানেই সফল হয়েছেন

আবুল কাসেম খান, সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের শিল্পায়নে বড় ভূমিকা রেখেছেন এম এ হাসেম। শুধু উৎপাদন নয়, ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং খাতেও তিনি বড় অবদান রেখেছেন। ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান গড়েছেন। তাঁর প্রস্থান দেশ ও ব্যবসায়ীদের জন্য বড় ক্ষতির।

একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে কঠোর পরিশ্রম ও মেধার জোরে এম এ হাসেম দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। উনি ব্যবসায় ক্যালকুলেটিভ রিস্ক (হিসাবি ঝুঁকি) নিতে পারতেন। তবে ব্যবসার সবকিছু নিজে দেখাশোনা করতেন না। ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দক্ষ ও পেশাদারদের হাতে ছেড়ে দিতেন। নিজেদের ব্যবসায় আমরা দেখেছি, সব কাজ নিজে করা যায় না। অনেক সময় সঠিক লোক নিয়োগ করতে না পারলে লোকসানও হয়। তবে এম এ হাসেম সাহেবের প্রতিষ্ঠানে দেখেছি, উনি সঠিক লোক নিয়োগ করতেন। এটি একটি বড় দক্ষতা।

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক বিষয়ে পারটেক্স গ্রুপ অন্যতম। এম এ হাসেম যখন মাম পানি বাজারে আনলেন, তখন অনেকেই এটির সাফল্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ বলতেন বোতলজাত পানি কে টাকা দিয়ে কিনবে। কিন্তু তিনি পানিকে শুধু বোতলে ভরলেন না, বোতলের নকশায়ও বেশ গুরুত্ব দিলেন। বোতলের নকশার কারণে মাম পানি আকর্ষণীয় হয় এবং বাজারে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরে উনি আরসি কোলা কোমল পানীয় বাজারে আনলেন। সেটিও অল্প সময়ে বাজার দখল করেছিল।

উদ্ভাবনী পরিকল্পনা আর ঝুঁকি নেওয়ার সাহস এম এ হাসেমকে সফল উদ্যোক্তা বানিয়েছে। তিনি যে ব্যবসায় হাত দিয়েছেন, সেখানেই সফল হয়েছেন। নন-ব্যাংকিং খাতেও যে ভালো ব্যবসা করা যায়, সেটি তিনি আইডিএলসির মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।