ভেজালের ভিড়ে আসল একটাই

প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কেজি পর্যন্ত রসমালাই বিক্রি হয়
ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের রসমালাইয়ের সুখ্যাতি দেশব্যাপী। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে কুমিল্লা অঞ্চলে গেলে ‘মাতৃভান্ডার’ নামের দোকানের অভাব নেই। ‘নিউ’, ‘আদি’, ‘প্রসিদ্ধ’—এসব শব্দ জুড়ে এই দোকানগুলো গড়ে উঠেছে। কিন্তু রসমালাইয়ের জন্য সেই প্রসিদ্ধ মাতৃভান্ডারের কুমিল্লা শহর ছাড়া আর কোথাও কোনো শাখা নেই। শহরের প্রাণকেন্দ্র মনোহরপুরেই একমাত্র শাখা। ভেজালের ভিড়ে আসল মাতৃভান্ডার একটিই। কুমিল্লা মাতৃভান্ডারের রসমালাই এতটাই জনপ্রিয় যে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কেজি পর্যন্ত বিক্রি হয়। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার সকালে মাতৃভান্ডারের সামনে রসমালাইপ্রেমীদের লাইন পড়ে যায়। লাইন ধরে রসমালাই কিনতে হয়।

১৯৩০ সালে কুমিল্লার শহরের মনোহরপুরের শ্রী রাজরাজেশ্বরী মন্দিরের উল্টো দিকে মাতৃভান্ডার মিষ্টির দোকানটি গড়ে ওঠে। ওই সময় এর পাশাপাশি ভগবতী প্যারা ভান্ডার ও শীতল ভান্ডার নামেও দুটি মিষ্টির দোকান হয়। করপোরেট মিষ্টির ব্যবসায়ীদের ভিড়ে ছোট ব্যবসায়ীদের যখন টিকে থাকা দায়, তখন প্রায় এক শতাব্দী ধরে কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের রসমালাই স্বাদে অনন্য হয়ে টিকে আছে।

রসমালাই কিনতে লম্বা লাইন
ছবি: প্রথম আলো

মাতৃভান্ডারে আধা ঘণ্টা

কুমিল্লার মনোহরপুরের মাতৃভান্ডার কেন এত জনপ্রিয়, রসমালাইপ্রেমীরা কেন ছোটেন মাতৃভান্ডারে, তা দেখতে গত ২৮ অক্টোবর যাই মাতৃভান্ডারের সামনে। সকাল ১০টা ২০ মিনিট থেকে ১০টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত দেখলাম মাতৃভান্ডারের কারবার। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দেখলাম তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম। ওই ৩০ মিনিটে মোট ৪৬ জন ক্রেতা ঢুকেছেন। তাঁদের প্রায় সবাই এক থেকে চার কেজি পর্যন্ত রসমালাই কিনেছেন। মাতৃভান্ডারে প্রবেশপথের ডান পাশে ক্যাশ কাউন্টার। ক্যাশ কাউন্টারের বিপরীতে র‌্যাকে রসমালাই, প্যারাসহ বিভিন্ন মিষ্টান্ন সাজানো আছে। র‌্যাকের পেছনে ৮ থেকে ১০ জন কর্মী দাঁড়িয়ে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী রসমালাই সরবরাহ করছেন। আর পাশের টেবিলে এক থেকে দুই কেজি ওজনের রসমালাইয়ের প্যাকেট রাখা আছে। এসব প্যাকেট চলে যাচ্ছে ক্রেতার হাতে। দোকানের পেছনের কারখানা থেকে আসছে রসমালাইয়ের প্যাকেট। ক্রেতা ও বিক্রয়কর্মীর হাঁকডাক তো চলছেই। দামাদামির কোনো বালাই নেই। এক কেজি রসমালাই ২৮০ টাকা।

ছবি: প্রথম আলো

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মাতৃভান্ডারের সামনে কথা হলো কুমিল্লা শহরের চর্থা এলাকার মধ্যবয়সী মাসুদ পারভেজের সঙ্গে। তাঁর হাতে রসমালাইয়ের প্যাকেট। তিনি পেশায় ছোট ব্যবসায়ী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি সপ্তাহে অন্তত এক কেজি রসমালাই দুই মেয়ের জন্য নিয়ে যেতে হয়। মেয়েদের খুব পছন্দ রসমালাই। আর কুমিল্লার রসমালাই মানেই মাতৃভান্ডার। তাই প্রতি সপ্তাহে এখান থেকে রসমালাই কেনেন।

মাতৃভান্ডারের কারবার দেখার জন্য যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন বেশ কয়েকটি অটোরিকশাযোগে এল দুধভর্তি প্লাস্টিকের ড্রাম। প্রতিটি ড্রামে কমপক্ষে ২০ লিটার দুধ। দুধের চালান আসার সঙ্গে সঙ্গে কারখানার কর্মীরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। পাঁচ থেকে ছয়জন কর্মী এসে দুধের ড্রাম কারখানায় ভেতরে নিয়ে যান। এর মধ্যেই চলছে বেচাকেনা। জানা গেছে, প্রতি দিন সকাল ও বিকেলে দুধের চালান আসে। অনেক সময় চাহিদা অনুযায়ী দুধের চালান না এলে ক্রেতাদের রসমালাই না নিয়েই মলিনমুখে ফিরে যেতে হয়।

বেলা পৌনে ১১টার দিকে দেখা গেল সেজেগুজে অটোরিকশায় করে মাতৃভান্ডারের সামনে এক পরিবার এল। পরিবারের কর্তা আবদুস সামাদ অনেকটা হাঁকডাক দিয়ে মাতৃভান্ডারে ঢুকলেন। চার কেজি রসমালাই নিলেন। আবদুস সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুমিল্লার চান্দিনায় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছি। রসমালাই না নিলে কি হয়?’ জানান, ৩৫ বছর ধরে তিনি মাতৃভান্ডার থেকে রসমালাই কেনেন।

কোথাও কোনো শাখা নেই

যেকোনো পণ্য জনপ্রিয় হলে উদ্যোক্তা ব্যবসা বাড়াতে উদ্যোগী হন। উৎপাদন বাড়িয়ে সারা দেশে শোরুম খোলেন। এটাই যেন ব্যবসার নিয়ম। কিন্তু এই নিয়মের পথে হাঁটেননি মাতৃভান্ডারের মালিক। কুমিল্লার শহরের মনোহরপুর ছাড়া মাতৃভান্ডারের আর কোনো শাখা বা শোরুম নেই।

কেন শাখা নেই, তা জানতে যোগাযোগ করা হয় মাতৃভান্ডারের স্বত্বাধিকারী অনির্বাণ সেনগুপ্তের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সব সময় মান ধরে রাখতে চাই; ভোক্তারা যেন ঠকে না যান। এ ছাড়া মাতৃভান্ডারের শাখা বাড়ানো হলে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী রসমালাই বানাতে পারব না। তাই আমরা একটি শাখা নিয়েই চলতে চাই।’ তবে প্রতিদিন কত কেজি রসমালাই বিক্রি হয় এবং কী পরিমাণ দুধ লাগে, তা জানতে চাইলে ব্যবসার গোপনীয়তার স্বার্থে প্রকাশ করেননি তিনি।

জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অঞ্চলে ‘মাতৃভান্ডার’ নামে ৭০টির বেশি দোকান আছে। কেউবা নামের আগে ছোট করে ‘আদি’, ‘নিউ’, ‘প্রসিদ্ধ’—এসব শব্দ জুড়ে দিয়েছেন। আর বিভ্রান্ত হন ক্রেতারা। কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই মনে করে কেনেন তাঁরা। এভাবেই ভেজালের ভিড়ে যেন আসল রসমালাইয়ের স্বাদ উধাও।
মাতৃভান্ডারের বয়স ৯১ বছর। ১৯৩০ সালে অনির্বাণ সেনগুপ্তের দাদা ফণীন্দ্র সেন এই ব্যবসার শুরু করেছিলেন। প্রথম দিকে চা-নাশতা, সবই বিক্রি হতো। ধীরে ধীরে চাহিদা বেড়ে গেলে শুধু মিষ্টির দোকান হিসেবে হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পায়। বিশেষ করে রসমালাইয়ের জন্য সারা দেশে সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর ফণীন্দ্র সেনের ছেলে শংকর সেনগুপ্ত মাতৃভান্ডারের দায়িত্ব নেন। ২০১৮ সালে তিনি মারা গেলে মাতৃভান্ডারের দায়িত্ব ছেলে অনির্বাণ সেনগুপ্তের হাতে পড়ে।

বর্তমানে ২২ থেকে ২৫ জন কর্মী আছেন। মাতৃভান্ডারের পেছনে কারখানা। সেখানে সারা দিন ১২ থেকে ১৫ জন রসমালাই, প্যারাসহ বিভিন্ন মিষ্টান্ন বানাতে ব্যস্ত থাকেন। দুধ থেকে রসমালাই বানাতে সাড়ে চার–পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। দিনে দুবার রসমালাইয়ের উনুন জ্বলে। এভাবেই বংশপরম্পরায় মাতৃভান্ডার চলছে।