যেভাবে এল ‘পেপাল মাফিয়া’

ফরচুনে প্রকাশিত পেপাল মাফিয়ার সেই বিখ্যাত ছবি

ছবিটা ছাপা হয়েছে ফরচুন ম্যাগাজিনের ২০০৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সংখ্যায়। ‘মিট দ্য পেপাল মাফিয়া’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো পেপালের কর্মী ও উদ্যোক্তাদের একটি দলকে ‘মাফিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ছবিতে রয়েছে জাওয়েদ করিম, জেরেমি স্টপেলম্যান, অ্যান্ড্রু ম্যাক করমেক, প্রিমল শাহ, লুক নোসেক, ক্যান হোয়েরি, ডেভিড ও স্যাক, পিটার থিয়েল, কিথ রোবইস, রিড হফম্যান, ম্যাক্স লেভচিন, রোয়েলভ বোথা, রাসেল সিমন্স। এলন মাস্ক ছবিতে নেই। কারণ, সময় মেলাতে পারেননি।

২০০২ সালে ই-বে পেপালকে কিনে নেয় মাত্র ১৫০ কোটি ডলারে। পেপালের প্রথম ৫০ কর্মী ও উদ্যোক্তার মধ্যে ১২ জন ছাড়া বাকিরা তখন সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। এই ৩৮ জনের সবাই পরে আলাদাভাবে বা একা একা নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি হলো টেসলা, লিঙ্কডইন, পলানটির টেকনোলজিস, স্পেসএক্স, স্লাইড, এফ্রিম, কিভা, ইউটিউব, ইয়েলপ ও ইয়াম্মার।

এই মাফিয়া গ্যাংয়ের গল্পের শুরু ১৯৮৬ সালে আমেরিকা থেকে অনেক দূরে, রাশিয়ার চেরনোবিল দুর্ঘটনার সময়ের। সে সময় চেরনোবিল থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বড় হচ্ছিলেন ম্যাক্স লেভচিন। লেভচিনের মায়ের কাজ ছিল খাদ্যে তেজস্ক্রিয়তা যাচাই করে সার্টিফিকেট দেওয়া। চেরনোবিলের দুর্ঘটনার পর যখন তেজস্ক্রিয় খাবারের পরিমাণ বাড়তে থাকে, তখন অফিসে তাঁকে একটি কম্পিউটার দেয়। উদ্দেশ্য, সহজে উপাত্ত বা ডেটা সংরক্ষণ করা।

২০০২ সালে ই-বে পেপালকে কিনে নেয় মাত্র ১৫০ কোটি ডলারে। পেপালের প্রথম ৫০ কর্মী ও উদ্যোক্তার মধ্যে ১২ জন ছাড়া বাকিরা তখন সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। এই ৩৮ জনের সবাই পরে আলাদাভাবে বা একা একা নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

লেভচিনের মা নিজে কোডিং শেখার সময় ছেলেকেও সঙ্গে নিলেন। যেদিন মায়ের সঙ্গে অফিসে যাওয়া হতো না, সেদিন লেভচিন বাড়িতে বসেই খাতা-কাগজে প্রোগ্রাম লিখতেন। এই শখই বড় হয়ে উঠল, যখন তাঁরা পারিবারিকভাবে আমেরিকায় পাড়ি দিলেন। লেভচিন আরবানা শ্যাম্পেইনে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে ভর্তি হন। এই সময় তাঁর ল্যাবেও কাজের সুযোগ হলো।

তাঁর কোডিং প্রতিভা দেখে কয়েকজন সহপাঠী তাঁকে নিয়ে স্টার্টআপ গড়ার চেষ্টা করল। এভাবে তিন বছরে চার–চারটা স্টার্টআপের জন্ম দিয়ে কোনোটিতেই তারা সফল হলো না। পাস করতে না করতে বন্ধুরা চলে গেলেন সান ফ্রান্সিসকোতে, সিলিকন ভ্যালিতে। লেভচিন আরও কিছুদিন ইলিনয়ে ঘোরাঘুরি করে একদিন সকালে সিলিকন ভ্যালিতে হাজির। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পিটার থিয়েল নামের এক বিনিয়োগকারী, আইনজীবী ও উদ্যোক্তা একটি বক্তৃতা দেবেন। লেভচিন ছয়জন দর্শকের একজন হিসেবে সেখানে যোগ দেন এবং থিয়েলকে জানান যে তিনি একটি কোম্পানি করতে চান।

সে সময়ে লেভচিনের ধ্যানজ্ঞান ছিল কম্পিউটার নিরাপত্তা। তাঁর প্রস্তাব ছিল, তাঁরা একটি ক্রিপটো লাইব্রেরি বানাবেন এবং সেটার লাইসেন্স বিক্রি করবেন। কোম্পানির নাম দেওয়া হয় ফিল্প লিংক। কিন্তু কাজ শুরু করার পর টের পাওয়া গেল, এর তেমন কোনো চাহিদা নেই।

পিটার থিয়েল তখন বললেন, টাকা রাখার কোনো বুদ্ধি করা যায় কি না। লেভচিন ক্রিপটোগ্রাফি দিয়ে নিরাপদ একটা আইওইউ তৈরি করতে সক্ষম হলেন। কোম্পানির নাম দেওয়া হলো ইনফিনিটি ইন কনফিডেন্স বা কনফিনিটি। দুটো পামটপ ডিভাইসে তাদের সফটওয়্যার থাকবে এবং দুটির ইনফ্রারেড পোর্ট ব্যবহার করে টাকা আদান–প্রদান করা যাবে।

লেভচিনের ধারণা হলো, যেহেতু এর মাধ্যমে নিরাপদে টাকা স্থানান্তর করা যাবে, কাজেই এটি খুব জনপ্রিয় হবে। কিন্তু সেটা হলো না। কারণ, জটিল এই পদ্ধতিতে টাকা বিনিময়ের জন্য দুজনকে কাছাকাছি আসতে হয়। এই সময়ে কেউ একজন লেভচিনকে পরামর্শ দিল, পামটপের ব্যাপারটা বাদ দেওয়া যায় কি না। লেভচিন দেখলেন সেটি সম্ভব। পামটপের পরিবর্তে লোকের ই-মেইল ঠিকানার সঙ্গে তাঁর এই জটিল পদ্ধতি জুড়ে দেওয়া যায়। তখন দুজন ব্যক্তির ই-মেইল থাকলেই তাঁরা টাকা বিনিময় করতে পারবেন।

তখন তাঁরা তাঁদের কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রাখে পেপাল। এখানে আপনার ব্যাংক হিসাব বা ক্রেডিট কার্ড থেকে পেপাল অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে পারবেন। তারপর ওই অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য পেপাল অ্যাকাউন্টে টাকা আদান-প্রদান করা যায়।

অচিরেই পেপাল আর এক্সডটকম দেখল, নিজেরা নিজেরা লড়াই করলে তারা পথে বসে পড়বে এবং কোনো তৃতীয় পক্ষ সেই জায়গা দখল করে ফেলবে। কাজেই এলন মাস্ক ও পিটার থিয়েল বসে একদিন ঠিক করল এক্সডটকম ও পেপাল এক হয়ে যাবে। মার্চ ২০০০ সালে দুই কোম্পানি পেপাল নামে একত্র হয়ে গেল।

লোকে তাও খুব একটা ব্যবহার করে না। তখন এলেন লুক নোসেক। বললেন, ‘আমরা তাহলে নতুন অ্যাকাউন্ট বা হিসাব খুললে তাকে ১০ ডলার দিই। আর কেউ যদি কারও রেফারেন্সে অ্যাকাউন্ট খোলে, তাহলে যে রেফার করবে, তাকেও ১০ ডলার।’ এই ঘোষণার পর অনেকেই পেপালে হিসাব বা অ্যাকাউন্ট খুলতে শুরু করল। যারা নিজেদের মধ্যে টাকা আদান–প্রদান করল। তারা দেখল, এটা খুবই ভালো।

এদের কেউ কেউ ই-বেতে বেচাবিক্রির সময় পেপালে টাকা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে শুরু করল। ই-বে হচ্ছে একটি অনলাইন নিলামের দোকান। এখানে বিক্রেতাকে টাকা পরিশোধ করাটা একটা ঝামেলা। প্রথমত, আপনি যদি ক্রেতা হন, তাহলে টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বসে থাকেন। আবার চেক পাঠালে সেটা বিক্রেতার হিসাবে ক্যাশ হতেই ১০ দিন পর্যন্ত লেগে যায়। ই-বের ব্যবহারকারীরা যখন পেপালকে তাঁদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেছেন, তখনো পেপালের কোনো লোগো ছিল না।

অনলাইনে টাকাকড়ি লেনদেনের এই সময় আরও কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যার মধ্যে এলন মাস্কের এক ডটকম বেশ এগিয়ে। এলন পেপালের সঙ্গে লড়াই শুরু করলেন। অচিরেই পেপাল আর এক্সডটকম দেখল, নিজেরা নিজেরা লড়াই করলে তারা পথে বসে পড়বে এবং কোনো তৃতীয় পক্ষ সেই জায়গা দখল করে ফেলবে। কাজেই এলন মাস্ক ও পিটার থিয়েল বসে একদিন ঠিক করল এক্সডটকম ও পেপাল এক হয়ে যাবে। মার্চ ২০০০ সালে দুই কোম্পানি পেপাল নামে একত্র হয়ে গেল।

টাকা পেয়ে পেপালের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা ও কর্মী ই-বে থেকে বের হয়ে নিজেরাই টেসলা, লিংকডিনের মতো নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে বা ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে। এই দলটিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউটিউবের সহপ্রতিষ্ঠাতা জাওয়েদ করিমও রয়েছেন।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউটিউবের সহপ্রতিষ্ঠাতা জাওয়েদ করিম

যখন পেপালের গ্রাহকসংখ্যা ২০ কোটি, তখন উদ্যোক্তারা ঠিক করল, এখন বিক্রি করা যায়। তারা গুগল ও ইয়াহুকে বলল ৬০ কোটি ডলারে পেপাল কিনে নিতে। পেপাল ই-বের জিনিস বলে ইয়াহু বা গুগল রাজি হলো না। এরপর ই-বে ৮৫ কোটি ডলারে পেপাল কেনার প্রস্তাব দিলে সেটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তখন প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে তাদের মূল্যমান ছিল ১২০ কোটি ডলার। বাধ্য হয়ে ই-বে ২০০২ সালে পেপালকে কিনে নেয় ১৫০ কোটি ডলারে।

টাকা পেয়ে পেপালের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা ও কর্মী ই-বে থেকে বের হয়ে নিজেরাই টেসলা, লিংকডিনের মতো নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে বা ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে। এই দলটিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইউটিউবের সহপ্রতিষ্ঠাতা জাওয়েদ করিমও রয়েছেন। ফরচুন ম্যাগাজিনের পর থেকে পেপাল মাফিয়া শব্দটি তাদের সবার জন্য প্রযোজ্য হয়ে যায়।

বর্তমানে ১৯০টি দেশে ৩৬ কোটির বেশি ব্যবহারকারী পেপাল ব্যবহার করে। পেপালের এখন বাজারমূল্য ২৭৫ বিলিয়ন (২৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার)।