শহুরে নারীদের সঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়ির মেলবন্ধনের গল্প

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।

টাঙ্গাইলের যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং-এর মালিক রঘুনাথ বসাকের বয়স এখন ৭২ বছর। তাঁর পূর্বপুরুষদের হাত ধরেই বংশপরম্পরায় শাড়ির এ ব্যবসা চলছে। পূর্বপুরুষেরা মুর্শিদাবাদ থেকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে টাঙ্গাইলে শাড়ি তৈরির উপযুক্ত আবহাওয়ার সন্ধান পেয়েছিলেন বলেই সেখানে থিতু হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে হাতবদলে নিজেদের বাড়িতেই গড়ে তোলা যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং দায়িত্ব পেয়েছিলেন রঘুনাথ বসাক, এখন এর হাল ধরেছেন তাঁর ছেলে খোকন বসাক।

টাঙ্গাইল ব্যবসায়ী সমিতি এবং টাঙ্গাইল বসাক সম্মিলনী লিমিটেডের সঙ্গে যুক্ত রঘুনাথ বসাক মুঠোফোনের আলাপে ফিরে গেলেন ১৯৮০–এর দশকে। বললেন, ‘আপা তখন তরুণী। টাঙ্গাইল বেড়াতে এসে আমাদের কাছ থেকে শাড়ি কিনে ঢাকায় ফিরলেন। ঢাকায় ওই কাপড় বিক্রি করে উৎসাহ পেলেন। প্রেসিডেন্ট আবদুস সাত্তারের আমলেও আমাদের ঘরে কাপড় ছিল, কিন্তু বিক্রি না হওয়ায় চাল কেনার পয়সাও হাতে থাকত না। আমরা তখন সাড়ে ১০ বা ১১ হাতের কাপড় বানাতাম। আপা ১২ হাতের কাপড় বানানোর অর্ডার দিলেন। বিভিন্ন ডিজাইন দিলেন। রং ঠিক করে দিলেন। এর আগেও আমাদের ঢাকায় কাপড় বিক্রি হতো, তবে আপার মাধ্যমে নতুন জীবন ফিরে পেলাম। প্রথম দিকে আপা আসতেন আমি, আমার ভাই নারায়ণ বসাক ও মতিয়ার রহমানের কাছ থেকে শাড়ি নিতে, তারপর থেকে আমরাই যাই তাঁর কাছে কাপড় পৌঁছে দিতে, তা এখনো অব্যাহত আছে।’

রঘুনাথ বসাক কথা শেষ করলেন, ‘এক অর্থে আপার হাত ধরে দেশের ক্রেতাদের হাতের নাগালে টাঙ্গাইল শাড়ি পৌঁছে যাওয়ায় দেশে ইন্ডিয়ান ছাপা প্রিন্টের চাহিদা কমেছে। আপাও তাঁত, তাঁত পরিবারের সদস্যদের ভালো–মন্দের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন।’

‘এক অর্থে আপার হাত ধরে দেশের ক্রেতাদের হাতের নাগালে টাঙ্গাইল শাড়ি পৌঁছে যাওয়ায় দেশে ইন্ডিয়ান ছাপা প্রিন্টের চাহিদা কমেছে। আপাও তাঁত, তাঁত পরিবারের সদস্যদের ভালো–মন্দের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন।’
রঘুনাথ বসাক, যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং

রঘুনাথ বসাকের এই আপা হলেন মনিরা ইমদাদ। শহুরে জনপদে এই মনিরা ইমদাদের হাত ধরেই টাঙ্গাইল শাড়ির মেলবন্ধন শুরু হয়। আস্তে আস্তে শহুরে নারীদের কাছে এ শাড়ি জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৯৮২ সালে মনিরা ইমদাদ রাজধানীর বেইলি রোডে একটি ছাপরায় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির নামের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। নিজে উদ্যোক্তা হিসেবে শাড়ি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেই ক্ষান্ত হননি, নারীরা দোকানে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করতে পারেন তার পথও তিনিই দেখিয়েছিলেন। টাঙ্গাইল, পাবনাসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁত পরিবারের নারীরা শাড়ি তৈরির আগে সুতা বানাচ্ছেন বা অন্য কাজ করছেন, তাঁদের কাজকেও হিসাবের খাতায় আনার উদ্যোগও নিয়েছিলেন মনিরা ইমদাদ।

চারুশিল্পী ও গবেষক শাওন আকন্দ বাংলাদেশের তাঁত প্রসঙ্গে প্রথম আলোতে বিভিন্ন লেখা লিখেছেন। তেমনই ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর ‘বাংলাদেশের তাঁতের শাড়ি’ শিরোনামের লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘...বাংলাদেশের তাঁতের শাড়ি বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক। ষাট ও সত্তরের দশকে, স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে ও পরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিশেষভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। এর সূত্র ধরে বাংলাদেশে তাঁতের শাড়ি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও এলিট শ্রেণি—এই শহুরে নাগরিক পরিসরে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে ওঠে। ঢাকায় আশির দশকের গোড়ায় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির এবং পরবর্তীকালে আরও অনেক বুটিক হাউস বা ফ্যাশন হাউসের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছে। শহরের মানুষের রুচি ও নান্দনিক বোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাঁতের শাড়ি তৈরি ও বিপণনে এই সব ফ্যাশন হাউসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।’

অর্থাৎ শুধু রঘুনাথ বসাক নন, তাঁত বা টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির বা মনিরা ইমদাদের নাম অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। মনিরা ইমদাদ বেইলি রোডের শাড়ি কুটিরের বৈঠকখানায় বসে প্রথমেই জানালেন, মনের আনন্দে কাজ করেই এত দিন ধরে টিকে আছেন। পিট লুম বা গর্ত তাঁত, ফ্রেম লুম, চিত্তরঞ্জন বা জাপানি তাঁত, কোমর তাঁতসহ বাংলাদেশের তাঁতের সার্বিক দিক নিয়ে অভিজ্ঞতাও হয়ে বিস্তর। যত দিন শরীর কুলাবে, তত দিন তিনি এ শাড়ির সঙ্গেই থাকবেন। জীবিত থাকতে শাড়ির সঙ্গে এ ভালোবাসার বিচ্ছেদের কথা তিনি কখনোই ভাবেন না।

টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরে মুনিরা ইমদাদ
ছবি–আশরাফুল আলম

প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলার সময় মনিরা ইমদাদের পরনে ছিল পাবনার একটি তাঁতের শাড়ি। জানালেন, উপহার হিসেবে অন্য ধরনের কিছু শাড়ি আছে তাঁর আলমারিতে। তবে সেগুলো সেভাবে পরা হয় না। তাঁতের শাড়ি, জামদানি ছাড়া অন্য শাড়ি পরলে অন্যরাই বলতে থাকেন, আপনি এমন শাড়ি পরেছেন কেন? তাই বলতে গেলে ৭০ ছুঁই ছুঁই বয়স পর্যন্ত তাঁতের শাড়িতেই কেটে গেল তাঁর জীবন।

এখনকার শহুরে নারী ও মেয়েরা উৎসব ছাড়া শাড়ি পরতে চান না। তাই শাড়ির রমরমা অবস্থাও নেই। করোনার চাপসহ অন্যান্য কারণেও এ ব্যবসা মন্দার দিকে। তবে কখনোই হাল ছাড়েননি মনিরা ইমদাদ। বললেন, এবার দুই ঈদে ব্যবসা খুব খারাপ ছিল, তবে পূজায় তা পুষিয়ে গেছে। আর নারী বা মেয়েরা শাড়ি পরে না, সেই বাস্তবতাকে মাথায় রেখেই এগিয়ে চলছেন তিনি।

টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির ঘরে দেখা গেল, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁতে বোনা কাপড়েই আরামদায়ক কামিজ, ফতুয়া, পাঞ্জাবি এমনকি রাতের পোশাকও বানিয়েছেন মনিরা ইমদাদ। মনিরা ইমদাদ বললেন, ‘এখনকার হাল ফ্যাশন সম্পর্কে সব খবর রাখা সম্ভব হয় না। তবে কেউ চাইলে চট করে জিনসের প্যান্টের সঙ্গে কামিজ পরে যাতে কাজে বের হয়ে যেতে পারে, তা আবার যাতে আরামদায়কও হয়, সেদিকটাই প্রাধান্য দিই। আর গুণগত মানে কোনো হেরফের হওয়া চলবে না।’

শহুরে ক্রেতাদের কথা চিন্তা করেই টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির অনলাইনে শাড়ি ও অন্যান্য পোশাক বিক্রি করছে। ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগানো হচ্ছে। কোন কাপড় বা পোশাকে ঠিক যা যা ব্যবহার করা হয়েছে, তাই জানানো হয় ক্রেতাদের—বললেন মনিরা ইমদাদ। তাঁর মতে, ব্যবসায় টিকে থাকলে হলে সৎ হতে হবে। এখানে অসততার কোনো জায়গা নেই।

মনিরা ইমদাদের বেড়ে ওঠা কুমিল্লাতেই। ছোটবেলা থেকেই ফিটফাট থাকতে পছন্দ করতেন, যা এখনো ধরে রেখেছেন। ফিটফাট থাকার সুবাদে ছোটবেলাতেই বাবার কাছ থেকে ‘ফ্যাশনবাবু’ উপাধি পেয়েছিলেন। বাড়িতে সেলাই মেশিন থাকার সুবাদে তিনি নিজের মতো ডিজাইন করে পোশাক বানিয়ে পরতেন। সেই ছোটবেলাতেই সুই দিয়ে লেইছ বানিয়ে মাকে উপহার দিয়েছিলেন।

আশা ভোসলের সঙ্গে
ছবি–সংগৃহীত

ছোটবেলায় নিজের পরিবারের সদস্যদের করা বিভিন্ন প্রশংসার পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ভিত গড়ে দিয়েছিলেন প্রকৌশলী এবং পরে ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত স্বামী ইমদাদুল হক। স্বামী চাইতেন স্ত্রী যাতে ঘরে বসে না থাকেন। মনিরা ইমদাদ জানালেন, ১৯৮০ সালের দিকে স্বামী তাঁকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন আয়োজিত একটি কোর্সে ভর্তি করিয়ে দেন। বেইলি রোডের জমিতে একটি টিনের ঘরে একটি ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসাও শুরু করেন। কিন্তু তাতে মন বসাতে পারেননি তিনি। তবে স্বামী সেই যে ঠেলে ঘর থেকে বের করেছিলেন, তাতেই গড়ে তুলতে পেরেছিলেন টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির। স্বামী মারা গেছেন ২০১১ সালে।

টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মনিরা ইমদাদের ছোট বোনের শ্বশুরবাড়ি টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে ঘুরতে যাওয়ার গল্প। বেড়াতে গিয়ে পাথরাইল গ্রামে তাঁতিদের তৈরি শাড়ি দেখে মুগ্ধ হন। কিন্তু শাড়িগুলো সাড়ে ১০ থেকে ১১ হাতের। কিছু শাড়ির রঙের ব্যবহার ভালো ছিল না। তাঁতিরা প্রত্যেকেই দক্ষ এবং তাঁদের দিয়ে অনেক ভালো কাজ করানো সম্ভব—সব মিলে টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। তিনজন তাঁতি, ১৩০টি শাড়ি, একজন কর্মচারী নিয়ে বেইলি রোডের সেই ঝুপড়িতেই যাত্রা শুরু করে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির’। ঢাকায় এ ধরনের দেশি শাড়ির দোকানেরও সেই প্রথম যাত্রা শুরু। প্রথম মাসেই শাড়ি বিক্রি করে ২৫ হাজার টাকা লাভ, ফলে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা ছেড়ে শাড়ি বিক্রির ব্যবসা করার জন্য স্বামীকে রাজি করাতে শুধু কসরত করতে হয়েছিল।

১৯৮৪ সালে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের শোরুমের জন্য তিনতলা ভবন তৈরি হলো। বেইলি রোডে ছিমছাম এ শোরুম এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এ শোরুমে টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে ধীরে ধীরে যোগ হয় জামদানি, মিরপুর, পাবনা, মণিপুরি শাড়িসহ দেশীয় শাড়ি ও অন্যান্য পোশাক। শাড়ির এ উদ্যোগে এখন কয়েক হাজার তাঁতি ও পরিবারের সদস্যরা কাজ করছেন। ৬০ জন কর্মচারী কাজ করছেন। সারা ঢাকায় শোরুম হয়েছে ছয়টি।

মনিরা ইমদাদ বললেন, একজন নারী কম বয়স থেকেই শাড়ি কুটিরের শাড়ি বানানোর কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর এখন বয়স হয়েছে। নিজে কাজ করতে পারেন না। তাই তিনি নারীদের দল গঠন করেছেন, ওই নারীরা বিভিন্ন কাজ করে দিচ্ছেন। এভাবে টাঙ্গাইল, পাবনা, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ কত জায়গায় কতজনের যে কর্মসংস্থান হয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই। ব্যবসাটিও এখন আর হাজার নয়, কয়েক কোটি টাকার ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।

মনিরা ইমদাদ জানালেন, এক ছেলে এবং এক মেয়ে আমেরিকায় পরিবার নিয়ে থিতু হয়েছে। তাঁরা দেশে ফিরে এ ব্যবসার হাল ধরবেন, সে আশাও তেমন একটা নেই। ছেলেমেয়েদের আয়ের আলাদা উৎস আছে। ব্যবসার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের নাম আছে অবশ্য। দেশে একা থাকার জন্য বা ভালো থাকার জন্য আর কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না মনিরা ইমদাদকে।

মনিরা ইমদাদ
ছবি–সংগৃহীত

মনিরা ইমদাদ তাঁর কাজের জন্য ‘বিচিত্রা পুরস্কার’, ‘অনন্যা শীর্ষ দশ সম্মাননা’, ‘শেল্‌টেক্‌ ইন্ডিয়া অ্যাওয়ার্ড’, ইউনেসকো আয়োজিত হ্যান্ড স্কার্ফ প্রতিযোগিতায় ২০০৪ ও ২০১৪ সালে ‘সিল অব এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’সহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মহিলা সংস্থা থেকে পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা।
মনিরা ইমদাদ বাংলাদেশ ক্র্যাফট কাউন্সিলে ২০০৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময় প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে এ প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় বাংলা একাডেমি, ডিজাইনার বিবি রাসেলসহ বিভিন্নজনের সহযোগিতায় তাঁরা বাংলাদেশের জামদানিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য ইউনেসকোর কাছে প্রস্তাব করেছিলেন। ঐতিহ্যবাহী নকশা ও বুননের কারণে ২০১৬ সালে জামদানিকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেসকো।

১৯৭৪ সালে কুমিল্লা থেকে সমাজকল্যাণ বিষয়ে বিএ পাস করেন মনিরা ইমদাদ। অন্যান্য দেশি শাড়ি নিয়ে কাজ করলেও টাঙ্গাইল শাড়ির প্রতি মনিরা ইমদাদের ভালোবাসাটা একটু বেশি। বললেন, জামদানি শাড়ি একটু জমিদার স্টাইলের, দামটাও বেশি হয়। আর টাঙ্গাইল শাড়ি আলুর মতো, আলু যেমন সব তরকারিতে দেওয়া যায়, তেমনি টাঙ্গাইল শাড়িও বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যায়। কম দামের শাড়ি যেমন আছে, তেমনি আছে বেশি দামের শাড়ি। কেউ চাইলে ঘরেও পরতে পারেন বা চাইলে বিয়ে বা পার্টিতেও পরতে পারেন। টাঙ্গাইল শাড়ির জমিনে ন্যাচারাল ডাই, এমব্রয়ডারি, নকশিকাঁথার সেলাইসহ বিভিন্ন জিনিস যোগ করে তাতে ভ্যালু অ্যাড করা হয়। শহুরে নারীদের যাতে পছন্দ হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হয়।

এখন তাঁর শাড়ি কুটিরের শোরুমে ৯০০ থেকে শুরু করে সাড়ে চার লাখ টাকার শাড়িও বিক্রি হচ্ছে। সাড়ে চার লাখ টাকার জামদানি শাড়িটি বানাতে সময় লেগেছে এক বছর। এটি একটি বিদেশি বইয়ে বাংলাদেশের জাদুঘরের একটি জামদানি শাড়ির ছবি দেখে বানানো হয়েছে।

দীর্ঘ সময়ে শাড়ি ও তাঁতিদের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতায় মনিরা ইমদাদ বললেন, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন জায়গার তাঁতিরা নানা ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে। শাড়ির জন্য ভালো কাঁচামালের চরম সংকট। মান্ধাতার আমলের মতো এখনো রং গুলে কাপড় বানানো হচ্ছে। সরকারকে তো এ অসুবিধাগুলো দেখতে হবে। টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির নিজের প্রয়োজনে হয়তো উন্নত মানের কাঁচামাল সংগ্রহ করে কাজ চালাচ্ছে। কিন্তু এ সুবিধাগুলো তো সরকারকেই করে দিতে হবে। গুণগত মানের কাঁচামাল দিয়ে সাহায্য করবে সরকার। তাঁতি ও প্রকৃত দেশীয় শাড়ির সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো শাড়ি তৈরির কাঁচামাল বা সুতার অভাব এবং তাঁতিদের কোনো রকম সুযোগ-সুবিধা না দেওয়া। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগটা সরকারকেই নিতে হবে। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত এ দিকটায় তেমন নজর দেয়নি। ফলে আগামী ৫০ বছর পরে আর এ শিল্প টিকে থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বললেন, ‘হ্যান্ডলুম নিয়ে কিছু একটা করে যেতে চাই। অনেক কিছুই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নতুন তাঁতিদের দক্ষতা বা কাজে আগ্রহও তেমন নেই। তাই ভাবনাটা বেশি।’

টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরে মুনিরা ইমদাদ
ছবি–আশরাফুল আলম

মনিরা ইমদাদ এখনো শরীরটা ফিট রাখতে পেরেছেন। ছোটবেলার সেই ‘ফ্যাশনবাবু’ উপাধিটাও ধরে রেখেছেন। এর রহস্য জানতে চাইলে বললেন, ‘প্রথমত শাড়ি নিয়ে কাজ করে আমি কাহিল হই না। নিয়মিত ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাস মেনে চলি। শরীর ঠিক না থাকলে তো কাজ করতে পারব না। যত দিন পারি শাড়ি নিয়ে কাজ করব। এ কাজ না করলে বাঁচতাম না বা দম বন্ধ হয়ে যেত। তাই ছেলে শরফ ইমদাদ ও মেয়ে নর্মিন মোবাশ্বেরার কাছে গিয়েও বেশি দিন থাকতে পারি না।’

কম্পিউটারে ব্যবসার সব হিসাব–নিকাশ থাকলেও মনিরা ইমদাদ এখনো প্রতিদিন রাতে বাসায় ফিরে মোটা মাস্টার খাতার পাতা উল্টে হিসাবটা মিলিয়ে নেন। ব্যবসায় দীর্ঘদিন টিকে থাকার কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁতিদের দিদিমণি মনিরা ইমদাদ বললেন, যে কাজটা করছেন, তা মনঃপূত কি না তা দেখতে হবে। কাজটাকে ভালোবাসতে হবে। কাজটা নিয়ে স্পষ্ট ধারণাও থাকতে হবে। আর ব্যবসায় সততার কোনো বিকল্প নেই। সত্য কথা বলতেই হবে।

বেইলি রোডের নাটক পাড়ায় কটি গাড়ি চলাচল করছে, একসময় তা–ও গুনে বলে দিতে পারতেন মনিরা ইমদাদ। সেই দিন এখন আর নেই। বেইলি রোডের চেহারায় পরিবর্তন এসেছে। তবে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের ফটকে ‘১৯৮২ সাল থেকে’ লেখাটি এখনো যে কারও নজর কাড়ে। প্রতিষ্ঠানের সামনের কলাগাছের ভালো–মন্দও নজর এড়ায় না মনিরা ইমদাদের। মনিরা ইমদাদসহ ১১ ভাইবোন ও মা বেঁচে আছেন। আর মনিরা ইমদাদ নিজের প্রতিষ্ঠানের শাড়ি পরেই জীবন পার করে দিলেন।