শিউলি আচার্যের হারমোনিয়াম ও তবলার ব্যবসা

শিউলি আচার্য কুমিল্লা শহরে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম তারক মিউজিক। রাজধানীর বাইরে কুমিল্লার মতো শহরে একজন নারী সারা দিন দোকানে বসে হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোল, গিটার—এসব বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে বিক্রি করেন। সেই সাতসকালে কাজ শুরু করেন, আর বাড়ি ফেরেন রাতে।

আজ ৮ মার্চ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আমরা এই উচ্চশিক্ষিতা, ব্যতিক্রমী ও সাহসী নারী উদ্যোক্তার বর্তমান দিনকাল ও ব্যবসা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। বেশ সাহসের সঙ্গেই শিউলি আচার্য প্রথম আলোকে জানান, বাদ্যযন্ত্রের মতো ব্যতিক্রমী ব্যবসায় তিনি বহুদূর এগিয়ে যেতে চান। তিনি মনে করেন, সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে এ দেশের নারীরাও ব্যবসা করতে পারেন। তবে এ জন্য চাই একটু সুযোগ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। তাঁর এই ব্যবসায় আসার পেছনের গল্পটি বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক।
রাজনীতিবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী শিউলি আচার্য শুধু তাঁর বাবার অনুপ্রেরণাতেই বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসায়ে এসেছেন। এর পেছনের গল্পটি বলা যাক, শিউলির ঠাকুরদাদা শিরিষ আচার্য ১৯৪৫ সালে কুমিল্লা জেলা শহরে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা করেন। নিজ বাড়িতেই তিনি হারমোনিয়াম, তবলা বানিয়ে বিক্রি করতেন। শিরিষ আচার্যের ছেলে অর্থাৎ শিউলির বাবা নীহার রঞ্জন আচার্য ব্যবসাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। ১৯৬৫ সালে তিনি কুমিল্লার রাণীরবাজার এলাকায় ‘তারক মিউজিক’ নামে বাদ্যযন্ত্রের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলেন। প্রতিষ্ঠানটি বেশ প্রচার পায়। সেই সুবাদের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসায়েরও মোটামুটি প্রসার ঘটে। ফলে গত অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে যথেষ্ট সুনামের সঙ্গে কুমিল্লা শহরে ব্যবসা করেন নীহার রঞ্জন আচার্য। ২০২০ সালে অক্টোবর মাসে নীহার রঞ্জন আচার্য মারা যান।

নীহার রঞ্জন আচার্যের চার মেয়ের মধ্যে বড় দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে। তাই ব্যবসায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তিনি মারা যাওয়ার পর ব্যবসার হাল ধরেন তাঁর ছোট মেয়ে শিউলি আচার্য। তিনি দেড় বছর ধরে বেশ ভালোভাবেই চালাচ্ছেন তারক মিউজিক। গত বছরের নভেম্বরে শিউলির সঙ্গে তারক মিউজিকে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। হঠাৎ করে এই ধরনের ব্যতিক্রমী ব্যবসার হাল ধরতে গিয়ে কি সমস্যা হয়নি? এমন প্রশ্ন করতেই বেরিয়ে এল আসল খবর। শিউলি আচার্য জানান, ১৯৯৪ সালে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বাবা তাঁকে নিজ হাতে ব্যবসা বোঝাতে শুরু করেন। কোথা থেকে কাঠ কিনতে হবে, তামা কিনতে হবে কীভাবে, কোনটির দাম কত—এসব বিষয়ে সব সময়ে বাবার সঙ্গে কথা বলতেন শিউলি। একসময় ঘরে বসেই বাবার ব্যবসায়ের যাবতীয় হিসাব-নিকাশও দেখতে শুরু করেন তিনি। আস্তে বাবার সঙ্গে বিভিন্ন বাজারে গিয়ে কাঠসহ বাদ্যযন্ত্র বানানোর সব মাল কিনে আনতেন। তখন অনেকটা নীহার রঞ্জন আচার্যের সহকারী হিসেবেই শিউলি আচার্য কাজ করতেন।
শিউলি আচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা নিজ হাতে এই ব্যবসার জন্য আমাকে প্রস্তুত করেছেন। এ ছাড়া আমার মা জ্যোতি আচার্য নিজেও গানবাজনা করতেন। তাই এ ধরনের ব্যতিক্রমী ব্যবসায়ে আসতে মায়ের কাছ থেকে বাধা পাইনি।’

কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে রাজনীতি বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন শিউলি আচার্য। উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় অন্য পেশায় যাওয়ার সুযোগ থাকলেও তিনি তা করেননি, বরং বাবার অনুপ্রেরণায় পারিবারিক ব্যবসায়ে জড়িত হয়েছেন। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে ব্যবসার হাল ধরেন তিনি। তারক মিউজিকে তাঁর বাবার কোনো চেয়ার-টেবিল ছিল না। ফ্লোরে বসেই তিনি বেচাকেনা করতেন তিনি। এখন শিউলি আচার্যও বাবার মতো ফ্লোরে বসেই বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও বিক্রির কাজ করে থাকেন। তবে করোনার মধ্যে গত এক বছরে তিনি ব্যবসায়ে বড় পরিবর্তন এনেছেন। অনলাইনে বাদ্যযন্ত্র বিক্রির ফরমাশ নিয়ে হোম ডেলিভারি দেন। এ ছাড়া আগে যেখানে তারক মিউজিকে শুধু হারমোনিয়াম-তবলা বিক্রি হতো, এখন সেখানে বাঁশি, গিটার, দোতরা, বেহালা, কাহন, জিপসি—এসব বাদ্যযন্ত্রও বিক্রি হচ্ছে।

সংগীতের প্রতি তীব্র ভালোবাসা রয়েছে আচার্য পরিবারের। শিউলি জানান, তাঁর বাবা নীহার রঞ্জন আচার্যের ওস্তাদের নাম ছিল তারক। তাই ওস্তাদের প্রতি সম্মান দেখিয়েই নীহার রঞ্জন প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন তারক মিউজিক। প্রতিষ্ঠানটি নতুন বাদ্যযন্ত্র তৈরি ও বিক্রির পাশাপাশি পুরোনো যন্ত্র সারাইয়ের কাজও করে। তবে করোনার কারণে ব্যবসা কিছুটা কমেছে। আগে সব মিলিয়ে মাসে দু-তিন লাখ টাকার বাদ্যযন্ত্র বিক্রি হতো। এখন মাসে বিক্রি হয় এক-দেড় লাখ টাকার বাদ্যযন্ত্র। গত শনিবার শিউলি আচার্যের সঙ্গে আবারও মুঠোফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি অবশ্যই আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও এই ব্যবসায়ে আনব। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে এই ব্যবসায় বসাব। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সংগীত ভালোবাসতেন। সেই ধারাবাহিকতায় পরবর্তী প্রজন্মও সংগীতকে যেন ভালোবাসে, সেই ব্যবস্থা করব।’

কেন সুর-সংঘীত ও বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আপনাদের এত ভালোবাসা—এই প্রশ্নের জবাবে শিউলি আচার্য বলেন, ‘যাঁরা এখানে আসেন, তাঁরা খাঁটি মানুষ। তাঁরা গানবাজনা নিয়ে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে থাকলেও ভালো লাগে, মন ভালো হয়ে যায়।