সারজীনা মওদুদের অনলাইনে অন্দরসজ্জার ‘সেরাস্পেস’

সারজীনা মওদুদ

করোনা মহামারিকাল। অফিস-কাজ সবই বন্ধ। যেসব কাজে সাইট ভিজিট করতে হয়, গ্রাহকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হয়, সেসব কাজ প্রায় স্থবির। বছরখানেক আগে শুরু হওয়া ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন বা অন্দরসজ্জার প্রতিষ্ঠান ‘সেরাস্পেস’–এর দাপ্তরিক কার্যক্রমও বন্ধ। বাড়িঘর, অফিস–আদালতের অন্দরসজ্জার কাজটি আগে কেউ অনলাইনে করার চেষ্টা এ দেশে করেছে কি না, জানা নেই। কিন্তু সেরাস্পেসের সহপ্রতিষ্ঠাতা সারজীনা মওদুদ ভাবলেন, তিনি সে চেষ্টা করবেন। তাতে দুটো লাভ হবে বলে ভাবলেন সারজীনা। প্রথমত, করোনাকালেও নতুন প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখা যাবে। দ্বিতীয়ত, ঢাকা শহরের বাইরে, সারা দেশে, এমনকি বিদেশেও এই সেবা দেওয়ার দ্বার উন্মুক্ত হবে।

যেই ভাবা সেই কাজ। নতুন প্যাকেজ বানানো হলো, যার মধ্যে সবচেয়ে কম খরচের প্যাকেজটি হলো মাত্র ২ হাজার ৮০০ টাকার। প্রচারণার একপর্যায়ে হটলাইনে একটি ফোনকল আসে রাজশাহী থেকে। ফোনদাতা জানান, তাঁর টিনশেডের একটি বাসা রয়েছে। জানতে চাইলেন, তাঁর জন্য ২ হাজার ৮০০ টাকায় ইন্টেরিয়র ডিজাইন কনসালট্যান্সি সেবা দেওয়া যাবে কি না। আমরা আনন্দের সঙ্গে রাজি হলাম। বললেন সারজীনা। তিনি আরও বলেন ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল বাড়ি সাজানোর ব্যাপারটাকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া। অনলাইনেই আমরা সেটা করতে সক্ষম হলাম।’

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক ও প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর করে দেশে ফিরে আসেন সারজীনা। উদ্দেশ্য ছিল নিজে কিছু করবেন। অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শুরুতে একটি মার্কিন আইটি কোম্পানির ‘রিমোট জব’ শুরু করেন। এই সময় তাঁদের বাসাতেই একটি প্রতিষ্ঠান ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ করছিল। সারজীনা বলেন, ‘সেখান থেকে আমার কৌতূহল তৈরি হয় কীভাবে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করে। আমার মনে হলো এই কাজে অনেক সম্ভাবনা আছে’।

তখন এ বিষয়ে আরও খোঁজখবর নিতে শুরু করেন সারজীনা। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে, আবাসনপ্রতিষ্ঠানের তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সারজীনা বুঝতে পারেন, এটি একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। শুধু তা–ই নয়, এই খাতের জন্য যথেষ্ট মেধাবী ও সৃজনশীল লোকজনও রয়েছেন। দরকার শুধু একটি সমাধান, যা প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সাশ্রয়ী খরচে মানুষের চাহিদা পূরণ করবে। সেখানে মানুষের বিশ্বাস থাকবে, আস্থা থাকবে, জবাবদিহিও থাকবে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সহপ্রতিষ্ঠাতা নিজাম ফরিদ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন অন্দরসজ্জার প্রতিষ্ঠান ‘সেরাস্পেস’।

শুরুতে আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো সশরীর এই সেবা দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু গোল বাধল করোনা মহামারি। তাই বাধ্য হয়ে করোনার সময় ইন্টেরিয়র ডিজাইন বিষয়টি অনলাইনে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেন। সারজীনা বলেন, ‘করোনার কারণে চিন্তা করতে লাগলাম এ সেবা সহজে কীভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। সেই চিন্তা থেকে আমরা অনলাইনে এ সেবা চালু করি। তখন থেকে দেশে প্রথম অনলাইনভিত্তিক ইন্টেরিয়র ডিজাইন কনসালট্যান্সি সেবার শুরু।’

সারজীনার ধারণা ছিল, সরাসরি ইন্টেরিয়র ডিজাইন বা স্থাপত্যে পড়াশোনা না থাকায় কর্মীদের একটি ভিন্ন ইনসাইড দেওয়া তাঁর পক্ষে সহজ হয়। বিশেষ করে প্রযুক্তির ব্যবহারে তাঁর দখলটা সেখানে বাড়তি কিছু যোগ করেছে। সৃজনশীল ডিজাইনারদের সঙ্গে কাজ করাটাও একটা আনন্দের বিষয় বলে মনে করেন তিনি।

দেশে মানুষের মধ্যে সাধারণ ধারণা ছিল ইন্টেরিয়র ডিজাইন ধনীদের বিষয়। যাদের পক্ষে একটি বাড়ি বানানোই দুঃসাধ্য, তারা কীভাবে এটি গ্রহণ করবে—এ প্রশ্নের জবাবে সারজীনা বলেন, ‘এই জায়গায় সত্যি আমাদের অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। মানুষকে বিশ্বাস করাতে হয় যে তারা সত্যিকার অর্থে পেশাদার ডিজাইনার বা নকশাবিদদের পরামর্শ পাচ্ছে। খরচও কম। তখন তারা বুঝতে পারে, এই কাজ করা যায়। আমরা সেই জায়গায় কাজ করতে পেরেছি। আমাদের প্যাকেজ শুরু মাত্র ২ হাজার ৮০০ টাকা থেকে।’

সারজীনার মতে, দেশে অন্দরসজ্জার বাজারটি অনেক বড়। ভোক্তাপর্যায় থেকে তাঁরা ভালো সাড়া পাচ্ছেন। নতুন নতুন চাহিদাও আসছে। সম্প্রতি গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী অফিস ও বাণিজ্যিক কাজেরও পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। এতে স্টার্টআপগুলোর কর্মপরিবেশটা আনন্দময় হয়ে উঠবে বলে তিনি মনে করেন। গ্রাহকদের জানাশোনার ব্যাপ্তি বাড়ানো সম্ভব হলে এ খাতের আরও বিকাশ হবে বলে সারজীনার ধারণা।

দুজনের প্রতিষ্ঠানে এখন কর্মীর সংখ্যা ৪০, যার অর্ধেকই নারী। দেশের নানা প্রান্ত ছাড়া যুক্তরাজ্য ও কানাডাতেও তাঁরা কোনো না কোনো সেবা পৌঁছে দিতে পেরেছেন। এভাবে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছেন বলে জানান সেরাস্পেসের এই উদ্যোক্তা।

বাবা–মা রাশিয়ায় থাকাকালে সারজীনার জন্ম। দেশে ফিরে এ লেভেল শেষ করে যুক্তরাজ্য থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন। কিছুদিন আগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্কুল থেকে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ‘ডিজরাপ্টিং স্ট্র্যাটেজিক’কোর্স সম্পন্ন করে এখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এন্ট্রােপ্রনিউরশিপে দ্বিতীয় মাস্টার্স করছেন।

সাধারণ মানুষের বসবাস ও কাজের ‘স্পেস’ ক্রমাগত ‘সেরাস্পেস’ হয়ে উঠুক, সে লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে চান সারজীনা।