শিশুদের জন্য দুই তরুণের ‘বাবুল্যান্ড’

রাজধানীতে বাবুল্যান্ডের একটি শাখায় খেলাধুলা করছে শিশুরা
ছবি: বাবুল্যান্ডের সৌজন্যে

রাজধানী ঢাকায় উন্মুক্ত খেলার মাঠের সংখ্যা একদমই কম। বড়দের অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাঠে খেলাধুলার সুযোগ পেলেও ছোটদের খেলাধুলার জায়গা নেই বললেই চলে। ফলে ঢাকার শিশুদের শৈশব থাকছে খেলাধুলাবঞ্চিত। এ সমস্যা সমাধানে ২০১৮ সালে একটি ব্যবসার উদ্যোগ নেন দুই তরুণ—ইশনাদ চৌধুরী ও এনামুল হক। তাঁরা শিশুদের মাঠের বিকল্প হিসেবে খেলাধুলার ব্যবস্থা করেন। নাম দেন বাবুল্যান্ড।

শিশুরা যাতে তাদের শৈশবের শারীরিক ও মানসিক গঠন ঠিক করে নিতে পারে, সেই চিন্তা করে বাবুল্যান্ডের প্রতিষ্ঠা। ১ কোটি টাকা ও ১২ জন কর্মী নিয়ে শুরু করা সেই প্রতিষ্ঠানের এখন ৪টি শাখা। কাজ করছেন শতাধিক কর্মী।

ইশনাদ চৌধুরী, এনামুল হক

বাবুল্যান্ডের কার্যক্রম নিয়ে সম্প্রতি কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা ইশনাদ চৌধুরীর সঙ্গে। মিরপুর ডিওএইচএসে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে বসে তিনি শোনান বাবুল্যান্ড প্রতিষ্ঠার গল্প।

ইংরেজি মাধ্যম থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করে ২০০৯ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান ইশনাদ চৌধুরী। সেখানে ফিন্যান্সে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে ২০১১ সালের শুরুতে দেশে ফিরে আসেন।

ইশনাদ বলেন, ‘দেশে কিছু করার চেষ্টা ছিল সব সময়। এ জন্য উচ্চশিক্ষা শেষে এক দিনও যুক্তরাষ্ট্রে থাকিনি। দেশে ফিরে প্রথমে জ্বালানি খাতের একটি কোম্পানিতে কাজ শুরু করি। এখানে কাজ করার সময় নতুন ব্যবসার ধারণা তৈরি হয়।’ এরপর চাকরি ছেড়ে ২০১৪ সালে ব্যবসা শুরু করেন। বেছে নেন অ্যামিউজমেন্ট বা বিনোদন খাতকে। শুরুটা ছিল কক্সবাজারে প্যারাসেইলিং (প্যারাস্যুট দিয়ে আকাশে ওড়া) ব্যবসা দিয়ে।

দেশে তখন পর্যটকদের জন্য বাণিজ্যিকভাবে প্যারাসেইলিংয়ের কোনো সুযোগ ছিল না বলে জানান ইশনাদ। ফলে তাঁর এই সেবা চালুর অল্প দিনের মধ্যেই তা বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। প্রথম সাফল্যের পর ২০১৬ সালে টিনএজারদের জন্য ঢাকায় একটি বিপণিবিতানে বিনোদনকেন্দ্রে বিনিয়োগ করেন তিনি। ওই বিনোদনকেন্দ্রের জন্য বিভিন্ন উপকরণ আমদানি করতে গিয়ে পরিচয় হয় বাবুল্যান্ডের আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা এনামুল হকের সঙ্গে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে (বিবিএ) স্নাতকোত্তর করেন এনামুল। আমদানি ব্যবসার পাশাপাশি তাঁরও বিনোদন খাতের ব্যবসায় বিনিয়োগ ছিল।

একসময় এই দুই তরুণ মিলে চিন্তা করেন, নিজেরাই বিনোদনকেন্দ্র চালু করবেন। এ সময় দুজন মিলে ভেবে দেখেন ঢাকায় শিশুদের বিনোদনের সুযোগ বলতে গেলে নেই। এই সমস্যাকে তাঁরা সুযোগ হিসেবে নেন। সে অনুযায়ী ব্যবসার পরিকল্পনা সাজান। তারই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের মে মাসে মিরপুর-২ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন শিশু বিনোদনকেন্দ্র বাবুল্যান্ড।

ইশনাদ বলেন, ‘শৈশবে আমরা যেভাবে বেড়ে উঠেছি, এখনকার শিশুদের সেভাবে শরীরচর্চার সুযোগ করে দেওয়ার উদ্যোগ নিই। শুরুতে মিরপুরে ছয় হাজার বর্গফুট জায়গা ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলি শিশুদের খেলার রাজ্য। যেখানে রয়েছে শিশুদের খেলার নানা উপকরণ। বর্তমানে ঢাকায় বাবুল্যান্ডের যে চার শাখা রয়েছে, সেগুলোর আয়তন পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার বর্গফুট। এসব খেলার জায়গায় বা প্লেগ্রাউন্ডে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বাবুল্যান্ডে ৪০০ টাকার বিনিময়ে ২ ঘণ্টার জন্য খেলাধুলার সুযোগ পায় একটি শিশু। সঙ্গে অভিভাবক থাকলে তার জন্য বাড়তি গুনতে হয় দেড় শ টাকা।’

তবে ২ ঘণ্টা খেলাধুলার জন্য ৪০০ টাকা খরচ নেওয়াকে একটু বেশিই বলে মনে করেন বাবুল্যান্ডের একাধিক গ্রাহক। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইশনাদ চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকার পরিমাণ সেবার তুলনায় বেশি নয়। গ্রাহকেরা একবার ফাস্ট ফুডের দোকানে গেলে সাধারণত এর চেয়ে বেশি টাকা খরচ করেন।

কী আছে বাবুল্যান্ডে? প্রতিষ্ঠানটির আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা এনামুল হক বলেন, ‘শিশুদের জন্য কয়েকটি কমিক চরিত্র বানিয়েছি। এসব চরিত্র দিয়ে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা তাদের বিভিন্ন নীতিনৈতিকতা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

২০১৮ সালে ১২ জন কর্মী ও ১ কোটি টাকা বিনিয়োগে শুরু হয় বাবুল্যান্ডের কার্যক্রম। গ্রাহকদের সাড়া পেয়ে মিরপুর, উত্তরা, ওয়ারী ও বাড্ডায় চারটি শাখা চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ১০৫ জন কর্মী কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। প্রতিবছর বাবুল্যান্ডের ব্যবসা দ্বিগুণ হারে বাড়ছে বলে জানান ইশনাদ চৌধুরী।

নিজেদের অর্থায়ন ছাড়াও ১৪ জন অ্যাঞ্জেল বিনিয়োগকারী প্রায় ৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন বাবুল্যান্ডে। আগামী বছরের শুরুতে গ্রিনরোড ও ধানমন্ডিতে আরও দুটি শাখা চালুর কাজ চলছে বলে জানান উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি বাবুল্যান্ডের উদ্যোগকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে ফ্র্যাঞ্চাইজি শাখা খোলার পরিকল্পনাও করছেন তাঁরা। ইশনাদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের বিনোদনকেন্দ্রগুলো ব্যয়বহুল প্রকল্প। নিজেদের বিনিয়োগে সারা দেশে পৌঁছাতে চাইলে অনেক সময় লেগে যাবে। এ জন্য আমরা ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতিতে যেতে চাই। এর মাধ্যমে আগামী ৫ বছরে দেশে ৫০টি শাখা খুলতে চাই আমরা।’

তবে ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হলে অনেকটা চাপের মধ্যে পড়েন বলে জানান ইশনাদ। তিনি বলেন, ‘সে সময় প্রায় আট মাস বন্ধ ছিল বাবুল্যান্ডের কার্যক্রম। কর্মীদের বেতন দিতে পারিনি ঠিকভাবে। শুধু গ্রাহকদের সাড়া পেয়ে বিধিনিষেধ শেষের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। এখন সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছি।’ ইশনাদ চৌধুরী মনে করেন, লক্ষ্যে স্থির ও ব্যর্থতা মেনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা থাকলে যেকোনো উদ্যোগে সফল হওয়া যায়।