চাকরি ছেড়ে হোস্টেল ব্যবসায় সফল এক দম্পতি

রিজওয়ানুল্লাহ ইউসুফ ও শারমিন সুলতানা

রাজধানীতে কঠিনতম কাজগুলোর একটি হচ্ছে নিরাপদ আবাসনের বন্দোবস্ত করা। বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবী ব্যাচেলরদের জন্য সব সুযোগ-সুবিধাসহ বাসা মেলানো বেশ জটিল। এ সমস্যা সমাধানে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছে হোস্টেল পরিষেবা। এটি বেশ পুরোনো ব্যবসা হলেও সময়ের পরিবর্তনে হোস্টেল ব্যবসার ধরনও বদলেছে। মানুষ এখন আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধায় বসবাস করতে চান। সেই ব্যবস্থা করে দিচ্ছে ইউনিক হোম নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

 রাজধানীর উত্তরায় ইউনিক হোমের কার্যালয়ে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শারমিন সুলতানা এবং চেয়ারম্যান রিজওয়ানুল্লাহ ইউসুফের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানালেন, ব্যাচেলরদের যাতে কষ্ট করে বাসা খুঁজতে না হয়, সে জন্য তাঁদের এই উদ্যোগ। পড়ার টেবিল, খাট, ফ্রিজ, হাউসকিপিংসহ সব ধরনের উপকরণ ও সেবা দিচ্ছে ইউনিক হোম।

এই উদ্যোক্তা দম্পতি শারমিন সুলতানা ও রিজওয়ানুল্লাহ ইউসুফ দুজনের বাড়ি রাজশাহীর বাঘায়। উভয়েই ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই হোস্টেল ব্যবসায় সম্পৃক্ত হন দুজনে।

হোস্টেলে পড়াশোনা করছেন দুই শিক্ষার্থী
সংগৃহীত

যেভাবে শুরু

চতুর্থ বর্ষে থাকাকালে একবার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন শারমিন। এ জন্য কয়েক দিন হাসপাতালেও থাকতে হয়। তখন রাজধানীর সোবহানবাগের তল্লাবাগ এলাকায় একটি মেস বাসায় ভাড়া থাকতেন তিনি। বাসায় সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত না থাকায় অসুস্থতার সময় বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তখন নিজেই এমন ফ্ল্যাট বাসা মেস হিসেবে ভাড়া নেওয়ার চিন্তা করেন শারমিন।

কয়েক দিন খোঁজাখুঁজির পরে সোবহানবাগে চার কক্ষের একটি বাসা পেয়ে যান। তবে সেটি ভাড়া নেওয়ার জন্য ৫৬ হাজার টাকা অগ্রিম (অ্যাডভান্স) লাগত। বাবার কাছ থেকে সেই টাকা ধার হিসেবে নিলেন। শারমিন বললেন, ‘প্রথম সপ্তাহেই ফ্ল্যাটটির বেশির ভাগ সিট ভাড়া হয়ে যায়। ভালো সাড়া পেয়ে পরের মাসেই আরেকটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। এই দুই ফ্ল্যাট থেকে তখন মাসে ৪০ হাজার টাকার মতো মুনাফা হতো।’

স্নাতক শেষে ২০১৬ সালে বিয়ে করেন শারমিন সুলতানা ও রিজওয়ানুল্লাহ ইউসুফ। পরে দুজনে মিলে হোস্টেল ব্যবসা সামলাতে থাকেন। মাঝে ড্যাফোডিল ও ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন দুজনই। এ ছাড়া একাধিক প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানেও কাজ করেছেন তাঁরা। তবে শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে হোস্টেল ব্যবসাতেই সব মনোযোগ দেন এই দম্পতি। ব্যবসায়ের পরিধি বাড়াতে একপর্যায়ে ফ্ল্যাটের পরিবর্তে পুরো ভবন ভাড়া নেওয়া শুরু করেন তাঁরা। ২০২০ সালের মধ্যে ঢাকার সোবহানবাগ, শুক্রাবাদ ও ফার্মগেটে চারটি ভবনে ইউনিক হোমের কার্যক্রম চালু হয়।

হোস্টেলের ছিমছাম পরিবেশে পড়াশোনা করছেন দুই শিক্ষার্থী
সংগৃহীত

ব্যবসায় বড় ধাক্কা আসে করোনার সময়। তখন দেশে বিধিনিষেধ আরোপ হলে অনেকেই বাসা ছেড়ে দেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনটি ভবনই ছেড়ে দেন তাঁরা। আর ভাড়ায় ব্যাপক ছাড় দিয়ে শুধু একটি চালু রাখা হয়। রিজওয়ানুল্লাহ জানান, প্রায় ১৭ মাস এভাবেই চলেছে। ওই সময় তাঁদের প্রায় ১৬ লাখ টাকার মতো লোকসান হয়। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে ব্যবসা আবার লাভের মুখ দেখতে শুরু করে। পুনরায় তিনটি নতুন ভবন ভাড়া নেওয়া হয়।

এই ব্যবসায় নেমে বেশ কাঠখড় পোহাতে হয়েছে বলে জানান রিজওয়ানুল্লাহ। যেমন ২০১৭ সালে হঠাৎ একদিন বাসা ছেড়ে দিতে বলেন বাড়িওয়ালা। তাঁদের সঙ্গে একাধিকবার এমন ঘটনা ঘটে। রিজওয়ানুল্লাহ বলেন, ‘আমরা এখন ভবন ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়ির মালিকদের সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে চুক্তি করে থাকি।’

বর্তমান অবস্থা

হোস্টেল ব্যবসার জন্য এখন পর্যন্ত প্রায় চার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন এই দম্পতি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে তিন ধাপে কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ পেয়েছেন তাঁরা। যদিও এই বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে বললেন শারমিন।

 বর্তমানে রাজধানীর ধানমন্ডি, সোবহানবাগ, আশুলিয়া ও উত্তরায় ইউনিক হোমের মোট পাঁচটি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে মেয়েদের তিনটি ও ছেলেদের দুটি শাখা। এসব হোস্টেলে প্রায় এক হাজার জনের আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে কর্মী রয়েছেন ৮০ জনের মতো।

যেসব সুবিধা রয়েছে

ইউনিক হোমে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) ও এসিবিহীন—দুই ধরনের কক্ষই রয়েছে। নন-এসি কক্ষের প্রতি সিটের ভাড়া সাড়ে ৬ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর এসি কক্ষে সিট ভাড়া ৮ হাজার টাকা থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। উভয় ক্ষেত্রেই টেবিল, চেয়ার, তোশক, বালিশ, ক্যাবিনেট, লিফট, ফ্রিজ, ইন্টারনেট, লন্ড্রি, হাউসকিপিং, জেনারেটরসহ রুমের সাধারণ সব সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়া তিন বেলা খাবার, নামাজ ও পড়ার কক্ষ, নাশতা তৈরির রান্নাঘর, জিম সুবিধা ও খেলার জায়গা রয়েছে। মেয়েদের হোস্টেলে রয়েছে আলাদা নারী নিরাপত্তারক্ষী।

শারমিন জানান, যাঁরা বিভিন্ন পরীক্ষা দিতে বা প্রয়োজনীয় কাজে দূরবর্তী এলাকা থেকে ঢাকাতে আসেন, তাঁদের জন্যও ব্যবস্থা রয়েছে ইউনিক হোমে। যেমন একজন ব্যক্তি ন্যূনতম দৈনিক সাড়ে ৩৪৯ টাকায় এক মাস পর্যন্ত ইউনিক হোমে থাকতে পারবেন। ব্যক্তিপর্যায়ের গ্রাহকের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আবাসন চুক্তি রয়েছে ইউনিক হোমের। হোস্টেলে কঠোরভাবে নিয়মকানুন মেনে চলা হয় জানিয়ে শারমিন বলেন, ‘হোস্টেলে নেশাজাতীয় দ্রব্য একেবারে নিষিদ্ধ। এ ছাড়া নিয়মিতভাবে হোস্টেলের অধিবাসীদের খোঁজখবর রাখা হয়। তাঁদের কেউ মানসিকভাবে অসুবিধায় থাকলে কাউন্সেলিং করার জন্যও আমাদের লোক রয়েছে।’

হোস্টেলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষও আছে
সংগৃহীত

ব্যবসায়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও জানান শারমিন। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা রাজধানী ঢাকাতে অন্তত ৩৫টি শাখা চালুর পরিকল্পনা নিয়েছি। এ ছাড়া দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহর ও গুরুত্বপূর্ণ জেলাতেও কার্যক্রম বিস্তৃত করার চিন্তা রয়েছে আমাদের।’

হোস্টেল ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ পাওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানান শারমিন। তিনি বলেন, ‘ঢাকাতে আবাসনের সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। সেখানে আমরা নিরাপত্তাসহকারে জনবহুল শহরে বড় একটি সমস্যার সমাধান করছি। তবে দেশে হোস্টেল ধরনের ব্যবসা এখনো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ কারণে যথাযথ নথিপত্র থাকার পরও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংকঋণ আমরা পাইনি।’