প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া এক কারখানা

উর্মি গ্রুপের কারখানা ফখরুদ্দিন টেক্সটাইলে প্রায়ই সুতা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটত। তাতে উৎপাদনপ্রক্রিয়া বিঘ্নিত হতো। সেই সমস্যার সমাধান করতে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

উর্মি গ্রুপের পরিবেশবান্ধব কারখানা ইউএইচএমে কাজ করছেন শ্রমিকেরা। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের আদমজি ইপিজেডে
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

প্রতিদিন কারখানায় শত শত সুতার কার্টন আসছে। সেগুলো বড় টালি খাতায় লিপিবদ্ধ করে গুদামে রাখা হচ্ছে। এরপর যেদিন কাপড় তৈরির জন্য সেই সুতার দরকার পড়ে, সেদিন কিন্তু তা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার সুতা থেকে কাপড় তৈরির পরও একই সমস্যা দেখা যায়। প্রায়ই নির্দিষ্ট কাপড়ের খোঁজ মিলছে না। এমন নয় যে গুদাম থেকে চুরি হচ্ছে। বিশাল গুদামের কোথাও না কোথাও কাপড় পড়ে আছে। অথচ সময়মতো কর্মীরা তা খুঁজে পাচ্ছেন না।

সমস্যাটি ছোট হলেও তাতে কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। প্রায়ই উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সময়মতো সুতা না পাওয়ায় আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান কী? খুঁজতে খুঁজতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের কর্মীদের দিয়েই একটা সফটওয়্যার তৈরি করল প্রতিষ্ঠানটি। গুদামে বসানো হলো রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন (আরএফআইডি) প্রযুক্তির সামান্য কিছু যন্ত্রপাতি। তারপর শুরু হলো এক বছরের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম।

কর্মীদের প্রশিক্ষণও চলল সমানতালে। পরের বছর থেকে পাকাপাকিভাবে নতুন পদ্ধতিতে গুদামে সুতা সংরক্ষণ শুরু হলো। পরে একই ব্যবস্থা গ্রে বা সাদা কাপড় সংরক্ষণেও চালু করা হয়। বর্তমানে গুদাম থেকে সুতা বা কাপড় কয়েক মিনিটের মধ্যেই খুঁজে বের করতে পারছেন কর্মীরা। তাতে সময় অপচয় কমেছে। এখন আর সুতা বা কাপড় হারিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সব মিলিয়ে কারখানার উৎপাদনও বেড়ে গেছে।

উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ
ছবি: প্রথম আলো

এভাবেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে গুদামে সুতা ও কাপড় সংরক্ষণব্যবস্থা চালু করে সফল হওয়া প্রতিষ্ঠানটির নাম ফখরুদ্দিন টেক্সটাইল মিলস। এটি গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত এবং রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান উর্মি গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ফখরুদ্দিন টেক্সটাইল মিলসে আরএফআইডি প্রযুক্তি ব্যবহারে সফলতার জন্য গত বছর ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার পেয়েছে উর্মি গ্রুপ।

রাজধানীর গুলশানে উর্মি গ্রুপের কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আসিফ আশরাফের সঙ্গে সম্প্রতি প্রথম আলোর দীর্ঘ আলাপ হয়। এ সময় তিনি বলেন, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করছি আমরা। ফলে উৎপাদনব্যবস্থায় অটোমেশন করতেই হবে আমাদের। ধাপে ধাপে আমরা কাজটি করার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে বস্ত্রকলে সফলভাবে আরএফআইডি চালু করতে পেরেছি। এখন আমাদের লক্ষ্য তৈরি পোশাকের উৎপাদন পর্যায়েও অটোমেশন করতে।’

ফখরুদ্দিন টেক্সটাইল মিলে আরএফআইডি প্রযুক্তি ব্যবহার দেখতে গত ডিসেম্বরে আমরা গাজীপুরের শ্রীপুরে গিয়েছিলাম। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আসুন আমরা উর্মি গ্রুপের শুরুর দিকের গল্পটা জেনে নিই। প্রতিষ্ঠানের এমডি আসিফ আশরাফের বাবা প্রয়াত ফখরুদ্দিন আহমেদ ইটভাটার ব্যবসা শুরু করেন ১৯৫৫ সালে। তার বছর তিনেক পর স্টোনভেলি ইঞ্জিনিয়ারিং নামে নির্মাণ কোম্পানি গঠন করেন। বঙ্গভবনের মূল ফটকসহ বিভিন্ন সেতু নির্মাণের কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি।

এমন তথ্য দিয়ে আসিফ আশরাফ বলেন, ‘বাবার নির্মাণপ্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেতু নির্মাণের কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সেসব সেতুর নকশা সরবরাহ করতেন। সে জন্য পাকিস্তান আর্মি ছয়বার বাবাকে ধরতে আমাদের পুরান ঢাকার ওয়ারীর বাসায় অভিযান চালায়। যদিও বাবা এর আগেই আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন।’

১৯৭৪ সালে উর্মি নেভিগেশন ও ১৯৭৯ সালে উর্মি শিপিং কোম্পানি চালু করেন ফখরুদ্দিন আহমেদ। কোম্পানি দুটির অধীনে তখন ১৩-১৪টি জাহাজ ছিল। সেগুলো জ্বালানি তেল, পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করত। মাছ ধরার ট্রলারও ছিল তাঁর। ১৯৮৩ সালে ফখরুদ্দিন আহমেদ মারা যান। পরের বছর তাঁর ছোট ভাই ছোট্ট পরিসরে ঢাকার গুলশান-তেজগাঁও লিংক রোডে স্টোনভেলি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের গুদামে উর্মি গার্মেন্টস চালু করেন।

স্নাতক শেষ করে ১৯৯১ সালে পারিবারিক ব্যবসায় আসেন আসিফ আশরাফ। শুরুতে তিনি জাহাজের ব্যবসা দেখতেন। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে ভর্তি হন। আইবিএর পড়াশোনা শেষে তিনি পাকাপাকিভাবে ব্যবসায় জড়িত হন। ১৯৯৪ সালে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন অ্যাটায়ার্স ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি নামে নতুন আরেকটি পোশাক কারখানা।

বর্তমানে উর্মি গ্রুপের অধীনে পোশাক ও বস্ত্র খাতে চারটি কারখানা রয়েছে—উর্মি গার্মেন্টস, অ্যাটায়ার্স ম্যানুফ্যাকচারিং, ইউএইচএম এবং ফখরুদ্দিন টেক্সটাইল মিলস। এসব কারখানায় কাজ করেন ১৪ হাজার শ্রমিক। গত বছর উর্মি গ্রুপ ১৯ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যা দেশীয় মুদ্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। তৈরি পোশাক ও বস্ত্র কারখানার বাইরে উর্মি গ্রুপের তিনটি তেলের ট্যাংকারও রয়েছে। এগুলো দেশের ভেতরে বিভিন্ন গন্তব্যে জ্বালানি তেল পরিবহন করে।

ফখরুদ্দিন টেক্সটাইল মিলসে আরএফআইডি প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন একজন কর্মী

ফখরুদ্দিন টেক্সটাইলে একদিন

গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে একদিন শীত শীত সকালে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে আড়াই ঘণ্টায় আমরা পৌঁছাই ফখরুদ্দিন টেক্সটাইলে। ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল ছিমছাম আর পরিপাটি কারখানা চত্বর। কারখানার বিভিন্ন ইউনিটে আরএফআইডি প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা দেখাতে আমাদের সঙ্গী হলেন উর্মি গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (আইটি) কাজী এহতেশাম শহীদ।

প্রথমেই গেলাম সুতার গুদামে। সেখানে কাজী এহতেশাম শহীদ জানান, কাভার্ড ভ্যানে সুতা আসার পর সেই চালানের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত যেমন: পরিমাণ, কার্টন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি তথ্য গুদামের প্রবেশ দরজায় একটি কাউন্টারের কম্পিউটারে এন্টারপ্রাইজ প্ল্যানিং সফটওয়্যারে (ইআরপি) ইনপুট দেওয়া হয়। পরে সেসব তথ্য আরএফআইডি সফটওয়্যারে পাঠানো হয়। তখন আরএফআইডি ট্যাগ কাভার্ড ভ্যানে থাকা সুতার প্রতিটি কার্টনে লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপর সুতার কার্টন গুদামে ঢোকানো হয়। ওই কাউন্টারের ওপর একটি আরএফআইডি অ্যানটেনা ও রিডার রয়েছে। যখন সেই রিডারের নিচ দিয়ে এক এক করে কার্টনগুলো নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তা সফটওয়্যারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এন্ট্রি হয়।

এন্ট্রির কাজ শেষ হলে নির্দিষ্ট শেলফে সুতার কার্টন রেখে দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে যখন নিটিংয়ের সুতা পাঠানোর সময় আসে, তখন কর্মীরা নির্দিষ্ট সুতার কার্টন খুঁজতে সফটওয়্যারের সাহায্য নেন। সেখান থেকে তথ্য নিয়ে নির্দিষ্ট শেলফে চলে যান। কোনো কারণে সেখানে না পেলে হস্তচালিত আরএফআইডি ট্যাগ রিডার ব্যবহার করেন। এ জন্য রয়েছে মোবাইল অ্যাপ। সেই অ্যাপে কার্টনের গায়ে লাগানো আরএফআইডি ট্যাগের নম্বর এন্ট্রি দেওয়া হয়। তারপর হাতে রিডার নিয়ে কর্মীরা গুদামে হাঁটতে থাকেন। তখন রিডার দিয়ে একধরনের শব্দ হতে থাকে। খুঁজতে থাকা নির্দিষ্ট কার্টনটির কাছাকাছি থাকলে রিডার উচ্চ শব্দ করে। এভাবেই কাঙ্ক্ষিত সুতার কার্টন খুঁজে বের করেন গুদামের কর্মীরা।

একইভাবে সুতা দিয়ে নিটিং মেশিনের কাপড় তৈরির পরও আরএফআইডি ব্যবস্থার মাধ্যমে গুদামজাত করা হয়। আবার ডায়িং ইউনিটে পাঠানোর সময় ব্যাচ আকারে কাপড় পাঠানো হয়। সেখানেও আরএফআইডি ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়। এর ফলে কারখানার সুতা থেকে কাপড় উৎপাদনের সব কটি ধাপ স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মধ্যে চলে এসেছে।

উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, ‘আগে আমরা প্রায় দিনই সুতা হারিয়ে ফেলতাম। সমস্যা সমাধানের প্রথম উদ্যোগ নেন আমাদের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মীর আশরাফুল হোসেইন। তিনি আরএফআইডি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রেও সেমিনারে অংশ নেন। ২০১৮ সালে প্রথম আমরা ব্যবস্থাটি চালু করি।’ তিনি বলেন, ‘স্বয়ংক্রিয় এই ব্যবস্থার কারণে আমাদের মেশিন বসে থাকছে না। তাতে উৎপাদন বেড়েছে।’

সেলাইবিহীন পোশাক

ফখরুদ্দিন টেক্সটাইল মিলসের চত্বরে সিমলেস বা সেলাইবিহীন পোশাকের ইউনিট গড়ে তুলেছেন আসিফ আশরাফ। সেখানকার বিশেষ নিটিং মেশিনে টি-শার্ট, ট্রাউজার, সাঁতারসহ বিভিন্ন পোশাক তৈরি হচ্ছে। এসব পোশাকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিটিং মেশিনেই পোশাকের বড় অংশ হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য হাতে গোনা কয়েকটি অংশ সেলাই করতে হয়। এই সিমলেস পোশাকের ডায়িং ও ফিনিশিংয়ের জন্যও রয়েছে আলাদা ইউনিট।

উর্মির এই সিমলেস ইউনিট ২০১৬ সালে চালু হয়। বর্তমানে বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড পুমা, এমঅ্যান্ডএস, ওশান এবং নো টিম অ্যান্ড সোল্ডসের জন্য পোশাক তৈরি করছে তারা। সিমলেসে তৈরি একেকটি পোশাকের দাম সাধারণ পোশাকের চেয়ে বেশি। যেমন সিমলেসে তৈরি টি-শার্টের মূল্য ৬-৭ ডলার এবং ল্যাগিংসের মূল্য ১০-১১ ডলার। সব মিলিয়ে উর্মির এই ইউনিটের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ ৮০ লাখ ডলার।

আসিফ আশরাফ বলেন, ‘আগে স্পোর্টস ব্র্যান্ডগুলো শুধু সিমলেস পোশাক বানাত। এখন অন্যান্য ব্র্যান্ডও এ ধরনের পোশাক নিজেদের বিক্রয়কেন্দ্রে রাখছে। ফলে ভবিষ্যতে সিমলেস পোশাকের চাহিদা বাড়বে। বাংলাদেশে আমরাই প্রথম এ ধরনের পোশাক তৈরি করতে শুরু করি। পরে আরও কয়েকটি কারখানা এমন পোশাক উৎপাদনে এসেছে।’

শেষ কথা

তৈরি পোশাক উৎপাদনে উর্মি গ্রুপ যে শুধু তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দিয়েছে, তা নয়। নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেডে তাদের একটি পরিবেশবান্ধব কারখানাও রয়েছে। নাম ইউএইচএম। কারখানাটি পরিবেশবান্ধব হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ইউএসজিবিসি থেকে লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে।

গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে শ্রমিকদের এমএফএসের মাধ্যমে বেতন-ভাতা দেয় উর্মি গ্রুপ। তাদের কর্মীদের জন্য রয়েছে ন্যায্যমূল্যের দোকান। সেখান থেকে কম দামে নিত্যপণ্যসামগ্রী কিনতে পারেন তাঁরা। এ ছাড়া কর্মীদের যাতায়াতের জন্য পরিবহন সুবিধা ও নারীদের জন্য বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন দিয়ে থাকে উর্মি গ্রুপ।

আলাপচারিতার একপর্যায়ে নিজের ব্যবসা জীবনের মূল্যায়ন কীভাবে করবেন জানতে চাইলে আসিফ আশরাফ বললেন, ‘আমি কম চাহিদার মানুষ। আমি যতটুকু করতে পেরেছি, তার জন্য খুশি। দিন শেষে আমি শান্তি চাই। সে জন্য আমি সৎভাবে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করি। পোশাকশিল্পের জন্য নতুন কিছু যোগ করতে পারাটা আমার জন্য বিরাট ব্যাপার।’