পাবনায় পেঁয়াজে ফুল
উৎপাদন খরচ উঠছে না চাষিদের
মণপ্রতি আবাদ খরচ ১ হাজার ১০০ টাকা।
পেঁয়াজ কাটা, পরিবহন, হাটের খাজনাসহ উৎপাদন খরচ ১ হাজার ২৫০ টাকার বেশি পড়ে যায়।
৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে।
কৃষকেরা উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় এবার হালি বা মূল পদ্ধতির পেঁয়াজ আবাদ করে ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। বস্তুত, উৎপাদন খরচই তুলতে পারছেন না তাঁরা। পেঁয়াজ আবাদের মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি হওয়ায় ও পেঁয়াজ বীজে ত্রুটি থাকায় অনেকের গাছে এবার ফুল ধরেছে। এসব পেঁয়াজ বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না বলে কৃষকেরা পেঁয়াজ বিক্রি করে দিচ্ছেন। সে কারণে বাজারে পেঁয়াজের দাম পড়ে গেছে।
কৃষকেরা বলেন, মুড়িকাটা বা আগাম জাতের পেঁয়াজে ফুল আসা (পেঁয়াজ কলি) স্বাভাবিক হলেও হালি বা মূল পদ্ধতির পেঁয়াজে ফুল ধরা ক্ষতিকর।
এ ধরনের পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না বলে দাম কমে যায়। গত দুই বছরে পেঁয়াজের বেশি দাম দেখে সাঁথিয়া উপজেলার কৃষকেরা এবার পেঁয়াজ চাষে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু গাছে ফুল আসায় তারা এবার উল্টো লোকসানের মুখে পড়েছেন।
হালি পেঁয়াজে ফুল আসায় কৃষকেরা সব পেঁয়াজ বিক্রি করে দিচ্ছেন। তবে কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, বিশেষ ব্যবস্থায় এই পেঁয়াজ কিছুদিন সংরক্ষণ করা যায়।
সাঁথিয়ার বোয়াইলমারি পাইকারি পেঁয়াজের হাটের আড়তদার রাজা হোসেন বলেন, হাটে পেঁয়াজ বিক্রি করে কৃষকদের হাসিমুখে বাড়ি ফেরার কথা থাকলেও এখন তাঁরা কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফিরছেন। এই এলাকার ৮০ শতাংশ জমির পেঁয়াজে ফুল এসেছে। ফুল আসা পেঁয়াজের দাম খুব কম হয়। ফুল আসায় এবার কৃষকেরা যেভাবে হাটে পেঁয়াজ আনছেন, তাতে পাঁচ-ছয় মাস পরে পেঁয়াজের অভাব দেখা দেবে।
এবার সাঁথিয়ায় ১৬ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে বলে জানায় উপজেলা কৃষি কার্যালয়। গতবারের চেয়ে এবার প্রায় এক হাজার হেক্টর বেশি জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হচ্ছে। উপজেলায় দুই পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়। একটি হলো মুড়িকাটা; অন্যটি হলো হালি পদ্ধতি বা মূল আবাদ। সাঁথিয়ায় হালি পদ্ধতিতেই পেঁয়াজের সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়। এবার হালি পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে।
হালি পদ্ধতিতে আবাদ শুরু হয় জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে। মার্চ-এপ্রিল মাসে সেই পেঁয়াজ কৃষকের ঘরে ওঠে। বড় ধরনের ব্যতিক্রম না
হলে হালি পেঁয়াজে ফুল আসে না এবং এই পেঁয়াজ সারা বছর সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু কোনো কারণে হালি পেঁয়াজে ফুল এলে তা বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এবার প্রচুর পেঁয়াজ গাছে ফুল এসেছে। কৃষকেরা বলেন, যেসব পেঁয়াজে ফুল এসেছে, সেগুলো জমি থেকে তোলার পর এক থেকে দেড় মাসের বেশি রাখা যাবে না। অথচ সারা বছরের চাহিদা পূরণের উদ্দেশে৵ হালি পেঁয়াজ আবাদ করা হয়। কিন্তু কৃষকেরা জানেন, ফুল এসে যাওয়ায় এই পেঁয়াজ বেশি দিন সংরক্ষণ করা যাবে না, সে জন্য জমি থেকে তোলামাত্র সেই পেঁয়াজ বিক্রির জন্য হাটে ছুটছেন তাঁরা। এতে গত কয়েক দিনে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ অনেক বেড়ে গেছে।
পুণ্ডুরিয়া গ্রামের পেঁয়াজচাষি আবদুল মুন্নাফ বলেন, ‘অনেক আশা নিয়্যা ছয় বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করছিলাম, এর জন্য ঋণও নিতে হইছে। কিন্তু বড় ধরনের লস খায়া গেলাম। গত বছর বিঘায় ৬০ মণের মতো ফলন পাইছি। অথচ এবার ফলন পাইল্যাম বিঘায় ৩৫ থেকে ৪০ মণ। পেঁয়াজে ফুল আসায় এই পেঁয়াজ ঘরেও বেশি দিন রাখা যাবি না। তাই হাটে দাম যা–ই হোক, সেই দামেই পেঁয়াজ বেইচ্যা দেব।’
গত সোমবার সাঁথিয়ার পেঁয়াজের কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে, ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরে (১৫ থেকে ২০ টাকা প্রতি কেজি) পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। কৃষকেরা হিসাব দিয়ে বলেন, এবার মণপ্রতি পেঁয়াজের আবাদ খরচ ১ হাজার ১০০ টাকা। এর ওপর পেঁয়াজ কাটা, পরিবহন, হাটের খাজনা খরচ হিসাবে ধরলে সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ ১ হাজার ২৫০ টাকারও বেশি পড়ে যায়। ফলে এ অবস্থায় তাঁরা উৎপাদন খরচই তুলতে পারছেন না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্জীব কুমার গোস্বামী বলেন, মূলত তিনটি কারণে এবার পেঁয়াজে ফুল এসেছে। সেগুলো হলো—পেঁয়াজ আবাদের শুরুতে বৃষ্টি, বেশি বয়সী চারা লাগানো ও ত্রুটিযুক্ত পেঁয়াজবীজ বপন। এই তিন ধরনের সমস্যায় সব কৃষক পড়েননি। তবে কতজন কৃষকের এ ধরনের সমস্যা হয়েছে, তার সঠিক হিসাব তাঁদের কাছে নেই। আর কৃষকেরা যেভাবে বলছেন, ফুল আসা পেঁয়াজ অল্প কয়েক দিনে নষ্ট হয়ে যাবে, তা ঠিক নয়। তবে এ ধরনের পেঁয়াজ একটু কম টিকবে। কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থায় এই পেঁয়াজ কিছুদিন সংরক্ষণ করা যায়।