এত চাপ কীভাবে সামলাবেন অর্থমন্ত্রী

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন। এটি তাঁর চতুর্থ বাজেট।

অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-এর ধকল কাটতে না কাটতেই এল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেলসহ প্রায় সব জিনিসের বাড়তি দাম। তাতেই তৈরি হয়েছে বাড়তি চাপ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্কিন ডলারের সংকট। ডলারের বিপরীতে কমছে টাকার মান। প্রবাসী আয়ও কমতির দিকে। সংকটময় এই পরিস্থিতিতে আসছে নতুন বাজেট।

অর্থনীতির এ চাপ কাঁধে নিয়েই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন। এটি তাঁর চতুর্থ বাজেট। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য তিনি যে বাজেট বক্তব্য দেবেন, তার নাম দিয়েছেন ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন’।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গতকাল বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এমন একটি বাজেট দিতে যাচ্ছি, যাতে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করা যায় এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সব পদক্ষেপও থাকছে আগামী বাজেটে।’

আরও পড়ুন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ বাজেট এটি। অর্থ মন্ত্রণালয় গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আগামী বাজেটে অগ্রাধিকার পাবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। সংগত কারণেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষি খাত, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান, শিক্ষা খাত ইত্যাদিকে।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে আয় ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। অনুদানসহ ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এ ঘাটতি মোটানো হবে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোভিডের কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ তো বাড়াতেই হবে। পাশাপাশি সুষ্ঠুভাবে তা বিতরণের ব্যবস্থাও করতে হবে। আবার সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। কারণ, বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমাদের সরকারি ব্যয় কম। তবে সরকারের আয় বাড়াতে গিয়ে যাঁরা কর দেন, তাঁদের বেশি চাপ না দিয়ে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারীদের (টিআইএন) সবাইকে করের আওতায় আনা জরুরি।’

আরও পড়ুন

আয় বৃদ্ধির লক্ষ্য ৪৫ হাজার কোটি টাকা

এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর, এনবিআর বহির্ভূত কর, কর ছাড়া প্রাপ্তি মিলিয়ে নতুন অর্থবছরে আয়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৪৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। এ আয়ের মধ্যে এনবিআর আদায় করবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত ও অন্যান্য খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক অনুদান ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা।

অর্থনীতির এ সংকটময় সময়ে কীভাবে এত টাকা আদায় হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘করদাতাদের আওতা বাড়াচ্ছি। দেশে যে পরিমাণ মধ্যবিত্ত আছেন, তাঁদের অনেকেই করের আওতায় আসতে পারেন। তাঁরাও আস্তে আস্তে করজালের মধ্যে আসবেন।’

এক লাখ কোটির বেশি ব্যাংকঋণ

আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। আর বিদেশ থেকে ঋণ নেবে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশই নেওয়া হবে ব্যাংক থেকে, যার পরিমাণ ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ও অন্যান্য খাত থেকে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ মে পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ২৯ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশ নিতে হয়েছে। তবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার লক্ষ্য থাকলেও তা অনেক ছাড়িয়ে যাবে বলে সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

সুদ ব্যয়ই ৮০ হাজার কোটি টাকা

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য পরিচালন ব্যয় ধরা হচ্ছে ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা, যার বড় অংশই খরচ হবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে। এর মধ্যে সুদ পরিশোধবাবদ খরচ হবে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ, আর বিদেশি ঋণের সুদ ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

পাচার করা টাকায় সাড়ে ৭% কর

আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থ পাচারকারীদের জন্য বিশেষ একটি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বিদেশে অবস্থিত যেকোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ কোনো কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে প্রশ্ন করবে না। বিদেশে অবস্থিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে না আনলে ওই সম্পদের মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং বিদেশে অবস্থিত অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনলে তার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হতে পারে। আবার কেউ যদি বিদেশ থেকে অর্থ আনেন (মোটা দাগে পাচার করা অর্থ), তাহলে সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিলেই হবে—এমন প্রস্তাবও থাকছে। আয়কর অধ্যাদেশে নতুন এমন একটি ধারা সংযোজন করা হতে পারে, যা আগামী ১ জুলাই থেকে পরের এক বছরের জন্য কার্যকর থাকবে।

কমছে করপোরেট কর

কিছু কিছু ক্ষেত্রে করপোরেট কর কমতে পারে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার বর্তমানে সাড়ে ২২ শতাংশ। এটি কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হতে পারে। আর তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করহার বর্তমানে ৩০ শতাংশ। এটি কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হতে পারে। একক ব্যক্তির কোম্পানির করহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ করা হতে পারে। এ ছাড়া ব্যক্তিসংঘ ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা ও অন্যান্য করযোগ্য সত্তার করহার আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হচ্ছে। ব্যাংক, বিমা, মোবাইল ফোন, তামাক কোম্পানিসহ অন্যান্য শ্রেণির করপোরেট করহার অপরিবর্তিত থাকছে।

রপ্তানি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্যও সুখবর আসছে নতুন বাজেটে। পোশাক খাতের মতো সব রপ্তানি খাতের প্রতিষ্ঠানের করহার ১২ শতাংশ এবং সবুজ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। তবে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি খাতের উৎসে করহার দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। আর বস্ত্র খাতের সব শিল্পের ১৫ শতাংশ করহারের মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।

বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা। আগামী অর্থবছরও এটি অপরিবর্তিত রাখা হতে পারে। এ ছাড়া মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবসার সেবা মাশুলকে উৎসে করের আওতার বাইরে রাখার ঘোষণা আসতে পারে।

বিলাসপণ্যে শুল্ক-কর আরোপ হচ্ছে

ডলার সাশ্রয়ের জন্য আরও অর্ধশতাধিক পণ্যের ওপর নানা ধরনের শুল্ক বসতে পারে। বাড়তি শুল্ক বসানো হতে পারে—উচ্চ সিসির ব্যক্তিগত গাড়ি, টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর, এসি, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, টেবিলওয়্যার, শোপিস, ঝাড়বাতি, সাধারণ বাতি, সাবান, শ্যাম্পু, বিস্কুট, চকলেট, পাদুকা, টাইলস, স্যানিটারিওয়্যার, টেবিলওয়্যার, মদজাতীয় পণ্য ইত্যাদির ওপর। এসব পণ্যের কোনোটির ওপর আমদানি শুল্ক, কোনোটির ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়তে পারে। আবার কিছু পণ্যের ওপর নতুন করে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কও বসতে পারে।

গত ২৩ মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ফুল-ফল, আসবাব, প্রসাধনজাতীয় ১৩৫টি পণ্যের আমদানি পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করে। এটি অব্যাহত রাখা হতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি টাকা থাকলে আবগারি শুল্কের পরিমাণ বাড়তে পারে।

এ ছাড়া ফেসবুক, গুগলের মতো অনাবাসী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা আরোপ হতে পারে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ের ঋণখেলাপিদের ঋণ মওকুফ করা হলে তাদের করও মওকুফ করা হয়। এবার শর্ত কঠিন করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান পর্যায়ের ঋণখেলাপিদের ঋণ মওকুফ করা হলেও করমুক্ত থাকবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশি সমুদ্রগামী জাহাজ তাদের আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে আনলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত করমুক্ত রাখার ঘোষণা থাকতে পারে। এ ছাড়া দেশি মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট আরও ৫ শতাংশ বাড়তে পারে।