এনবিএলের টাকা কার পকেটে

২০০৯ সালে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদেরও বদল হয় ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের (এনবিএল)। ব্যাংকটির কর্তৃত্ব চলে যায় সিকদার গ্রুপের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদারের কাছে। নিজের স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন ও আওয়ামী লীগ নেতাদের পর্ষদে যুক্ত করে ব্যাংকটির একক নিয়ন্ত্রণ নেয় সিকদার পরিবার। এরপর আর অন্য উদ্যোক্তাদের ব্যাংকের ধারে ঘেঁষতে দেননি, পরিচালক তো নয়ই। ওই সময় থেকে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে সিকদার পরিবারের সম্পদ। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও। অন্যদিকে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে ঠিক তখন থেকেই।

ব্যাংক ছাড়াও বিমা, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, নির্মাণ, হোটেল, পর্যটন, এভিয়েশনসহ বিভিন্ন খাতে গ্রুপটির ব্যবসা রয়েছে। এ ছাড়া বিনিয়োগ আছে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডসহ আরও অনেক দেশে। অন্য দেশে করা বিনিয়োগের উৎস নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

সিকদার গ্রুপের হাতে যাওয়ার পরে পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও বেনামি ঋণের কারণে ২০১৪ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। জরুরি ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েও ন্যাশনাল ব্যাংকের খারাপ হওয়া রোখা যায়নি। এখন দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোর একটি ন্যাশনাল ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের অনেকগুলোই সিকদার পরিবার ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হচ্ছে। আবার বেনামি ঋণ সৃষ্টি করেও পরিবারটি ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে।

আইনে এক পরিবারের চারজন পরিচালক থাকার কথা বলা হলেও ন্যাশনাল ব্যাংকে আছেন সিকদার পরিবারের পাঁচজন। আইন, নীতিমালা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি কোনো কিছুই যেন ন্যাশনাল ব্যাংক ও পরিবারটির জন্য প্রযোজ্য নয়। বর্তমানে ব্যাংকটির ১১ সদস্যের পর্ষদে আছেন চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার, পরিচালক তাঁর স্ত্রী মনোয়ারা সিকদার, মেয়ে পারভীন হক সিকদার, ছেলে রিক হক সিকদার ও রন হক সিকদার। এ ছাড়া সিকদার ইনস্যুরেন্সের প্রতিনিধি হিসেবে আছেন ন্যাশনাল ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা বদিউল আলম। অন্য পরিচালকেরা নামে থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। অনেকে পর্ষদ সভাতেও নিয়মিত আসছেন না।

ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকে তাদের খেলাপি ঋণ ব্যাপক বেড়েছে। ২০০৯ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৩৮৮ কোটি টাকা, গত মার্চে যা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা।

বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকই সবচেয়ে বেশি অবলোপন করে আর্থিক স্থিতিপত্র থেকে খেলাপি ঋণ বাদ দিয়েছে। তারপরও কমাতে পারেনি খেলাপি ঋণ। অবলোপন করা এ ঋণ গত বছর ছিল ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকটি একাধিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ আদায় করতে না পারলেও তা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করছে না। এতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র বের হচ্ছে না। আবার ন্যাশনাল ব্যাংক নিজে যে পরিমাণ ঋণ খেলাপি দেখাচ্ছে, তার বিপরীতেও নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারছে না। গত মার্চে সঞ্চিতি ঘাটতি ছিল ৪৮৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীরাও লোকসানে। ১০ টাকা মূল্যের প্রতিটি শেয়ারের দাম এখন সাড়ে ৭ টাকা।

ন্যাশনাল ব্যাংকের গত এক যুগের আর্থিক প্রতিবেদন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদন ও বিভিন্ন নথি এবং বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বেসরকারি খাতের প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর একটি এই ন্যাশনাল ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, সাবেক অর্থমন্ত্রী আজিজুর রহমান মল্লিক। ব্যাংকটিতে কোনো শেয়ার না থাকার পরও উদ্যোক্তারা তাঁকে প্রথম ১০ বছর চেয়ারম্যান পদে রেখেছিলেন। এরপর শেয়ারধারীরা ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। তখন ভালো ব্যাংক হিসেবেই ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচিতি ছিল।

ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে ও মুঠোফোনে ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোস্তাক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে ন্যাশনাল ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) এস এম বুলবুল আহমেদের সঙ্গে শুক্রবার বেলা ৩টা ৩৭ মিনিটে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি এ সময় প্রায় সব অভিযোগই অস্বীকার করেন। এর মধ্যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এত বাড়ল কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা খালি নেতিবাচক দিকই দেখেন। ভালো কোনো দিকই চোখে পড়ে না। বিশেষ করে ব্যাংক খাতের।’

পর্ষদে একই পরিবারের চারজনের বেশি পরিচালক থাকা নিয়ে এস এম বুলবুল আরও বলেন, এটা আদালতের বিচারাধীন ঘটনা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে এ নিয়ে মামলা চলমান। নিষ্পত্তি হয়নি।

ভুয়া ঋণের সুবিধাভোগী যেভাবে
হাসান টেলিকম নামের একটি অখ্যাত কোম্পানির নামে ঋণ সৃষ্টি করে ব্যাংকটি থেকে টাকা বের করে নেয় সিকদার পরিবার। এ ঋণের আবেদন, অনুমোদন এবং বিতরণ সবই হয়েছে ২০১৮ সালের শেষের দিকে। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয় নভেম্বর মাসেই। বাকি ৩৮৫ কোটি টাকা তোলা হয় পরের তিন মাসের মধ্যে। হাসান টেলিকমের চেয়ারম্যান আরিফ হাসান একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক।

বিএফআইইউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, হাসান টেলিকমকে দেওয়া ঋণের ৬৪ কোটি টাকা সরাসরি জমা হয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রিক হক সিকদার, সিকদার গ্রুপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সৈয়দ কামরুল ইসলাম (মোহন) এবং সিকদার গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠান পাওয়ার প্যাক ও সিকদার রিয়েল এস্টেটের হিসাবে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের তদন্ত প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠিয়েছে। তবে দুদক এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর প্রথম দফায় হাসান টেলিকমের নামে ১০০ কোটি টাকা ছাড় করে ব্যাংক। সেদিনই ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রিক হক সিকদারের হিসাবে জমা হয় ২০ কোটি টাকা, সিকদার গ্রুপের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সৈয়দ কামরুল ইসলামের হিসাবে ১০ কোটি ২৮ লাখ টাকা ও গ্রুপটির মালিকানাধীন পাওয়ার প্যাকের হিসাবে যায় ১০ কোটি টাকা। বাকি অর্থ দিয়ে আরিফ হাসান নিজের নামে ন্যাশনাল ব্যাংকেই বিভিন্ন মেয়াদি আমানত হিসাব খোলেন।

একই বছরের ২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় আরও ১০০ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। এর মধ্যে ৪ ডিসেম্বর রিক হক সিকদারের পশ্চিম ধানমন্ডি শাখার হিসাবে জমা হয় ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১০ ডিসেম্বর সিকদার রিয়েল এস্টেটের হিসাবে জমা হয় ২০ কোটি টাকা। বাকি টাকা আবারও নগদে ও আরিফ হাসানের বিভিন্ন হিসাবে জমা হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আরও ৬০ কোটি টাকা ছাড় করে ব্যাংক। এ টাকা নগদে উত্তোলন করেন আরিফ হাসান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ নিয়ে বলা হয়েছে, কাগুজে কাজের আদেশের বিপরীতে পণ্য সরবরাহ ঋণের আড়ালে ৩৩৫ কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছেন আরিফ হাসান, ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও তাঁদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। বাকি ১৫০ কোটি টাকাও তাঁরা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন।

হাসান টেলিকমের নেওয়া ঋণের টাকা কীভাবে রিক হক সিকদার, সৈয়দ কামরুল ইসলাম ওরফে মোহন এবং পাওয়ার প্যাকের ব্যাংক হিসাবে গেল, এ নিয়ে প্রশ্ন করা হয় ব্যাংকটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম বুলবুলের কাছে। তিনি পাল্টা করে বলেন, ‘কে বলেছে? আমাদের কাছে এ রকম কিছু নেই।’ পরে অবশ্য তিনি বলেন, তবে এটা কিন্তু মানতেই হবে এখন যে সময় তাতে কেউ শতভাগ নিয়মকানুন মেনে ব্যবসা করতে পারবেন না। এমনকি ব্যাংকও কাজ করতে পারবে না।

আরও সুবিধা যেভাবে
২০১৭ সালে ব্যাংকটির শীর্ষ দুই খেলাপি গ্রাহক ছিল ইপসু ট্রেডিং ও কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল। এর মধ্যে ইপসুর কাছে পাওনা ছিল ১৪৫ কোটি টাকা ও কেমব্রিজের কাছে ১৩৫ কোটি টাকা। এসব ঋণ বিতরণ করা হয় ২০১৩ সালে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৫ সালেই এসব ঋণ প্রদানে অনিয়ম, ব্যবহার ও সুবিধাভোগী নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির নিমতলী শাখায় ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল ইপসু ট্রেডিংয়ের নামে হিসাব খোলার দুই দিন পরই ৪০ কোটি টাকার ঋণ ছাড় করা হয়। এ অর্থ দিয়ে সিকদার রিয়েল এস্টেটের জেড এইচ সিকদার শপিং কমপ্লেক্সের জায়গা (ফ্লোর) কেনা হয়। মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলী বাজারের এ শপিং কমপ্লেক্সে প্রতি বর্গফুট জায়গার দাম ১২ হাজার ৮২০ টাকা ধরা হয়, যা বাজারমূল্য অনুযায়ী কয়েক গুণ বেশি।

এ ছাড়া ব্যাংকের সীমান্ত স্কয়ার শাখায় ২০১৩ সালের ১৩ মে কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল হিসাব খুলেই ভবন ক্রয়ের জন্য ১৩২ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করেন গ্রাহক। পরদিন ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির সভায় তা অনুমোদনও হয়। এরপর ভবন বিক্রেতা ও ব্যাংকের পরিচালক মনোয়ারা সিকদারের অনুকূলে পে–অর্ডারের মাধ্যমে ২২ মে ৫৫ কোটি, ২৭ মে ৫৫ কোটি ও ২৮ মে ৪১ কোটি ছাড় করা হয়। এ ক্ষেত্রেও প্রতি বর্গফুট ফ্লোর কেনা হয় ১২ হাজার টাকায়। যার প্রকৃত সুবিধাভোগী সিকদার পরিবার বলে প্রতিবেদনে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেমব্রিজ ও ইপসুর টাকা কীভাবে সিকদার রিয়েল এস্টেটে গেল, এর জবাবে ব্যাংকের এএমডি এস এম বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপনি কীভাবে বলছেন? এটা কি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ? কই, বাংলাদেশ ব্যাংক তো আমাকে কিছু জানায়নি।’

আদায় নেই, খেলাপিও হচ্ছে না
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৮ সালের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলেছে, প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান এইচ বি এম ইকবালের মালিকানাধীন প্রিমিয়ার প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্টের নেওয়া সীমার বেশি ঋণ সমন্বয় না করলে খেলাপি করার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংক তা না করে বরং প্রতিষ্ঠানটির ২২৪ কোটি টাকা ঋণের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়ে দিয়েছে।

এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক খন্দকার নুরুল আফসারের মালিকানাধীন শপ ইন ট্রেড-এর ঋণও চার দফায় পুনঃ তফসিল করা হয়। এর আগে চারবার খেলাপি হলেও তা ঋণ তথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) জানায়নি ব্যাংকটি, নিজেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করেনি। ফলে পরিচালক পদে থেকে যান খন্দকার নুরুল আফসার।

আবার হামিদ রিয়েল এস্টেটের ঋণ ২০১৮ সালের প্রথম ৯ মাস শোধ না করলেও খেলাপি করা হয়নি। একইভাবে আফসার রিয়েল এস্টেট, ফ্রেন্ডস মাল্টি ট্রেড কোম্পানি ও মেসার্স চিটাগাং সিন্ডিকেটের ঋণ পরিশোধ না হলেও খেলাপি করা হয়নি।

২০১৮ সালে সাদ মুসা গ্রুপের ঋণ দাঁড়ায় ১ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। এর বড় অংশ ঋণ খেলাপি হলেও তা অশ্রেণীকৃত করে রাখা হয়। প্রতিষ্ঠানটি মাইশা গ্রুপের কর্ণধার সংসদ সদস্য আসলামুল হকের কাছ থেকে গাজীপুরের ১ হাজার ৬০০ শতক জমি কেনে, যার দলিল মূল্য ৩০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংক থেকে এ বাবদ নেওয়া হয় ১৫৮ কোটি টাকা। এ জমি দেখিয়ে ঋণের সীমা বাড়িয়েও নেওয়া হয়।

২০১৮ সালের ২৯ মার্চ নাফ ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ২৬০ কোটি ঋণ অনুমোদন হয়। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর ঋণসীমা বাড়িয়ে ৬৩০ কোটি টাকা করা হয়। এসব টাকা বিভিন্ন মাধ্যমে জমা হয় সোশ্যাল ইসলামী ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, চট্টগ্রামের বিভিন্ন শাখায়। এসব ঋণের জামানতও ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ নিয়ে বলা হয়, এভাবে ঋণের টাকা বিভিন্ন নামে অন্য ব্যাংকে জমার মাধ্যমে ঋণের প্রকৃত ব্যবহার হয়নি।

অনিয়ম ও পাচারের আলামত
ন্যাশনাল ব্যাংক মিলেনিয়াম গ্রুপকে যে ঋণ প্রদান করছে, তার পদে পদে নানা অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৬ সালের অক্টোবরে বিভিন্ন ব্যাংকে গ্রুপটির খেলাপি ঋণ ছিল ১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা, যা খেলাপি হিসেবে দেখাতে আদালতের স্থগিতাদেশ ছিল। ন্যাশনাল ব্যাংক ২০১৬ সাল শেষে এ গ্রুপের ঋণসীমা বাড়িয়ে ৩৩৪ কোটি টাকা করে, যা এখন আরও বেড়েছে। জানা গেছে, এটি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।

মিলেনিয়ামের ঋণের অনিয়ম নিয়ে এএমডি এস এম বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, মিলেনিয়ামের ঋণ খেলাপি হয়েছে তো। পুনঃ তফসিলের জন্য আবেদন করেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

এদিকে, ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি ইউনিট-২ স্থাপনে অর্থায়ন করে ব্যাংকটি। শুরুতে পর্ষদে অনুমোদন হয় যে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও জাহাজ আসবে কোরিয়া থেকে। কিন্তু পরে তা আসে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ থেকে। উল্লেখ্য, টাকা পাচার করে বেনামে কোম্পানি খোলার জন্য ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের বিশেষ খ্যাতি আছে। ইনডেক্স পাওয়ারের জন্য পর্ষদের সিদ্ধান্ত দফায় দফায় পরিবর্তন করা হয়। বদল হয় আমদানি পণ্যের আকারও। প্রতিষ্ঠানটি দফায় দফায় টাকা এক হিসাব থেকে অন্য হিসাবে এবং সংশ্লিষ্ট নয় এমন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মেসার্স ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি এবং ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি ইউনিট-২–এ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক লেনদেনে অর্থ পাচারের আলামত রয়েছে। চাপে পড়ে এর বেশি দূর এগোতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইনডেক্স অর্থ পাচার করেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আলামত পাওয়া নিয়ে জানতে চাইলে এস এম বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমাদের কিছু বলেনি। বরং ইনডেক্স মোংলা বন্দরে প্রকল্প করেছে। মালামাল স্টোরেজ করেছে।’

অপমান ও অপদস্থ
২০১৪ সালে ব্যাংকটির দুটি শাখায় বড় ধরনের ঋণ অনিয়ম উদ্‌ঘাটন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব ঋণ অন্যের নামে দেওয়া হলেও সিকদার পরিবারই যে এর প্রকৃত সুবিধাভোগী, তা চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর জন্য ব্যাংকটির এমডি এ কে এম শফিকুর রহমানকে দায়ী করে চাপ প্রয়োগ ও অপদস্থ করা হয়। ওই বছরের ১ অক্টোবর এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয় এ কে এম শফিকুর রহমানকে।

তখন ছিল ঈদের বন্ধ। এমডিকে অপদস্থ করার ঘটনায় ব্যাংক খাতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। এরপর ঈদের ছুটির মধ্যেই ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন পর্যন্ত ব্যাংকটিতে আর সুশাসন ফেরেনি, ফলে পর্যবেক্ষকও প্রত্যাহার করেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরপর এমডি হিসেবে নিয়োগ পান শরিফুল ইসলাম। তিনিও মেয়াদ শেষ করার আগেই পদত্যাগ করেন। ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় চৌধুরী মোস্তাক আহমেদকে। ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি তিনি এমডি হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন পান।

মাঝে প্রায় এক বছর এমডিশূন্য ছিল ব্যাংকটি। ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংকের এমডি পদ একাধারে তিন মাসের বেশি শূন্য রাখা যাবে না। এ সময়ের মধ্যে এমডি পদ পূরণ না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পথে এগোয়নি।

চৌধুরী মোস্তাক আহমেদ এক্সিম ব্যাংকের এমডিকে গুলি করার সময় উপস্থিত ছিলেন, ছবিতেও তাঁকে দেখা গেছে। ব্যাংকটির অতিরিক্ত এমডি এস এম বুলবুলও রয়েছেন সেই ছবিতে। সিকদার পরিবারের সব অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গী ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কমিটির অনেক সদস্য। এ নিয়ে অন্য ব্যাংকাররাও বিব্রত।

দেশের ব্যাংক খাতের এ পরিস্থিতি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকটির মালিকানা এক পরিবারের কাছে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এমন সুযোগ পেয়েছে। ব্যাংকের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেওয়া গেলে এভাবে টাকা নেওয়া যায়। এ জন্যই ব্যাংক দখল বন্ধ হয়নি। একজন ব্যক্তির কাছে সাত-আটটি ব্যাংক চলে গেছে। এ জন্য আইন করে কেন্দ্রীভূত হওয়া রোধ করতে হবে।

মইনুল ইসলাম আরও বলেন, এভাবে ঋণ ভাগাভাগির ঘটনা ব্যাংক খাতে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। একবার আস্থা হারিয়ে ফেললে পুরো ব্যাংক খাত চাপে পড়ে যাবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য কোনোভাবেই ভালো হবে না। এ জন্য এখনই ব্যাংকগুলো একীভূত করতে হবে। এতে পরিবারগুলোর নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যাংক বের হয়ে আসতে পারে।