কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে টাকার প্রবাহ বাড়াতে হবে

আসন্ন অর্থবছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে বড় বড় প্রকল্পে টাকার প্রবাহ বাড়াতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকে মনোযোগী হতে হবে।

জাতীয় বাজেট
প্রথম আলো

গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন। করোনার সময় কাজ হারিয়ে এখন বাড়িতেই থাকেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম তিনি। তাই চার সদস্য নিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে তাঁর জন্য। এলাকায় বিকল্প আয়ের পাশাপাশি ঢাকায় চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করছেন ইসমাইল হোসেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও অক্সফামের জরিপে উঠে এসেছে, করোনার প্রভাবে দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য বলছে, করোনায় নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছেন।আগামী অর্থবছরের বাজেট হবে জীবিকা উজ্জীবিত করার বাজেট, যেখানে প্রবৃদ্ধির চেয়ে জীবন রক্ষা করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে বেশি।

শামসুল আলম, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য

আগামী অর্থবছরের বাজেট হবে জীবিকা উজ্জীবিত করার বাজেট, যেখানে প্রবৃদ্ধির চেয়ে জীবন রক্ষা করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে বেশি।
শামসুল আলম, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, করোনার সময় আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাই হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি ও বেসরকারি দুভাবেই কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগের আওতায় বড় প্রকল্পের বাস্তবায়নে গতি বাড়াতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি উজ্জীবিত করতে স্থানীয় প্রকল্পগুলোতে পর্যাপ্ত টাকা দিতে হবে। ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, এমন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্তদের জন্য
আলাদা প্রণোদনা তহবিল দিতে হবে। ব্যক্তি খাতে ই-কমার্সকে প্রসারিত করতে রাখতে হবে বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ।

বাড়াতে হবে কর্মসংস্থান

সাধারণত শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ হলে সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কর্মসংস্থান হলে উৎপাদন বাড়ে। বছর শেষে যার প্রতিফলন দেখা যায় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সরকার মোট জিডিপির ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ৮ দশমিক ২ শতাংশ আর বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু অর্থবছরের ১১ মাস শেষ হতে চললেও এখন পর্যন্ত বিনিয়োগের সাময়িক হিসাব প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তাই এখন পর্যন্ত কতটুকু বিনিয়োগ হয়েছে কিংবা কর্মসংস্থানও কতটা হয়েছে, তা জানা যায়নি। সাধারণত, এপ্রিলের মধ্যে বিনিয়োগের সাময়িক তথ্য প্রকাশ করে থাকে বিবিএস।

তবে বিবিএসের কাছ থেকে বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া না গেলেও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ যে হয়নি, তা জানা গেল দুটি পরোক্ষ সূচক দেখে। একটি মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির, অন্যটি ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবাহের। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবাহ কমে গেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতেও ভাটা পড়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, কারখানার সম্প্রসারণ হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন না। ফলে কর্মসংস্থানও হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের জন্য বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছে ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মধ্যবর্তী শিল্পপণ্যের আমদানি কমেছে ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। কাঁচামালের আমদানি কমেছে ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ। সার্বিক আমদানি কমেছে ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

কারখানা সম্প্রসারণ কিংবা কারখানা স্থাপনের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ার অর্থ হলো কারখানায় নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না। ফলে কর্মসংস্থানও হচ্ছে না।

নেই কোনো কৌশল

চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিনিয়োগ নিয়ে সরকারের কোনো ধরনের কৌশল ছিল না। বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো নিয়ে কোনো রূপরেখা দেননি অর্থমন্ত্রী। বাজেটের পঞ্চম অধ্যায়ের সংস্কার ও সুশাসন অংশে অর্থমন্ত্রী শুধু বলেছেন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আগের অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যেও বিনিয়োগ নিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রায় একই কথা বলেছিলেন।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ঠিক যে করোনার প্রভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অসংখ্য মানুষ চাকরিচ্যুত হয়েছে। বেকার হয়েছে। আমাদের অর্থনীতির আরও ক্ষতি হতো পারত। কিন্তু সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপের কারণে অর্থনীতির ততটা ক্ষতি হয়নি।’ শামসুল আলম আরও বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট হবে জীবিকা উজ্জীবিত করার বাজেট, যেখানে প্রবৃদ্ধির চেয়ে জীবন রক্ষা করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে বেশি। আসছে অর্থবছরের বাজেটে কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

চাঙা করতে হবে গ্রামীণ অর্থনীতি

বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতির কারণে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) ভাটা পড়েছে। করোনার প্রভাবে সরকারের আয়ও কমে গেছে। কাজ হারিয়ে শহর ছেড়ে অসংখ্য মানুষ গ্রামে চলে গেছেন। আবার প্রবাসী অনেক বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসে গ্রামে ফিরে গেছেন। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর বিষয়টি মাথায় রেখে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করার তাগিদ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে বিশেষ নজর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা।

বিআইডিএসের তথ্যমতে, দেশের শিল্প খাতের কর্মসংস্থানের ৮৬ শতাংশ এসএমই খাতে। জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২৫ শতাংশ। সার্বিক শিল্প খাতে এই খাতের অবদান ৩২ শতাংশ। বিবিএসের সবশেষ জরিপ বলছে, দেশে ৭২ লাখের মতো এসএমই উদ্যোক্তা রয়েছেন। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার এসএমই খাতের জন্য যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, সেখান থেকে উদ্যোক্তারা কাঙ্ক্ষিত ঋণ পাননি বলে অভিযোগ উদ্যোক্তাদের।

বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তার হাতে পৌঁছেনি। তাঁদের জন্য আগামী অর্থবছরের বাজেটে আলাদা একটি প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া যেতে পারে। যাঁরা নতুন ব্যবসা শুরু করতে চান (স্টার্ট আপ), বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের ওপর জোর দিতে হবে। এতে করে গ্রামাঞ্চলে টাকার প্রবাহ বাড়বে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।