ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য আউটসোর্সিং পরামর্শ

আমাদের বেশির ভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রায় সব কাজ নিজের হাতে করেন। সেটি বাজারসদাই হোক (কাঁচামাল), সেলস পিচ হোক, ফেসবুক মার্কেটিং হোক। এমনকি হিসাব–নিকাশের কাজটাও নিজের হাতে রাখেন। বলা বাহুল্য, নতুন উদ্যোক্তার জন্য সব কাজই চ্যালেঞ্জিং। অনেকের ধারণা, অন্যকে দিয়ে করিয়ে নিলে ব্যবসার খরচ বাড়ে এবং আয় কমে যাবে। তা ছাড়া অনেকে ভাবেন, কোনো কাজ অন্যকে দিয়ে করিয়ে নিতে হলে সেটি তাকে বোঝাতে অনেক সময় নষ্ট হয়। তার পরিবর্তে নিজেরই করে ফেলা ভালো। অনেকেই ভাবেন, কর্মী মানেই সার্বক্ষণিক কর্মী। অনেকেরই শুরুতে এই সামর্থ্য থাকে না।

কিন্তু যাঁরা তাঁদের কাজে অন্যদের সহায়তা নিয়েছেন, তাঁদের সবারই কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়েছেন। আমেরিকার জুতা বিক্রির অন্যতম বড় অনলাইন দোকান ‘জাপ্পোস’-এর প্রয়াত সহপ্রতিষ্ঠাতা টনি সেই তাঁর ‘ডেলিভারিং হ্যাপিনেস’ বইয়ে মূল ও প্রধান কাজ ছাড়া অন্যান্য সহায়ক কার্যক্রম অন্যকে দিয়ে করিয়ে নেওয়ার (আউটসোর্সিং) পরামর্শ দিয়েছেন।

আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কিছু কাজ করিয়ে নিলে উদ্যোক্তা নিজের জন্য অনেক বাড়তি সময় বের করতে পারেন। এই সময়টা তিনি নিজের পণ্য ও সেবার মানোন্নয়নে ব্যবহার করতে পারেন। এ রকম সাতটি কাজের তালিকা এখানে দেওয়া হলো। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নিজের উদ্যোগ অনুসারে এগুলো আউটসোর্সিং/স্বয়ংক্রিয়করণ করে ফলাফল দেখতে পারেন।

১. মার্কেটিং ও ডিজিটাল মার্কেটিং
যেকোনো উদ্যোগের জন্য মার্কেটিংয়ের বিকল্প নেই। বর্তমানে উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের পণ্য ও সেবার মার্কেটিং নিজেরাই করে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর বহুল জনপ্রিয়তা, প্রতিনিয়ত তাদের অ্যালগরিদমের পরিবর্তন ও নতুন নতুন ফিচার যোগ হওয়ার কারণে, এমনকি একজন পেশাদার মার্কেটারেরও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খেতে হয়। স্পষ্টতই একজন উদ্যোক্তার পক্ষে নিজের পণ্য-সেবার বাইরে গিয়ে এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা অসম্ভব না হলেও খুবই দুরূহ। এখন অনেক ফ্রিল্যান্স ডিজিটাল মার্কেটার রয়েছেন। তাঁরা আপনাকে একটা কৌশল তৈরি করে সেটা বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারেন। খণ্ডকালীন কিংবা প্রজেক্ট/ক্যাম্পেইন ভিত্তিতে চুক্তি করা যায়। শুরুর দিকে আপনাকে একটু সময় ব্যয় করতে হবে আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং আপনার পণ্য-সেবার সঙ্গে তাঁকে পরিচিত করানোর জন্য। কিন্তু এরপরই আপনি কেবল মনিটরিং করে ভালো সুফল পাবেন।
গুগল, ফেসবুক বা টুইটারে বিজ্ঞাপন দেওয়া খুবই সহজ হওয়াতে অনেকে নিজেই কাজটা করেন। কারণ, একটা ক্রেডিট কার্ড থাকলেই কাজটি করা যায়। আবার অনেকেরই ক্রেডিট কার্ড নেই। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা আপনার হয়ে অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিতে পারে। এদের মাধ্যমে আপনি অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন।

২. লজিস্টিক সেবা
বর্তমানে অনেক উদ্যোক্তাই অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন এবং বিক্রীত পণ্য ক্রেতার ঠিকানাতে পৌঁছে দেন। এ জন্য অনেকেই নিজস্ব ডেলিভারি পারসন নিয়োগ দেন। যুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত লজিস্টিক সেবা প্রতিষ্ঠানের সেবা-মূল্য বেশি বলে অভিযোগ করেন। কিন্তু নিজের ডেলিভারি পারসনকে ট্র্যাক করা, সে কোনো বিপদে পড়লে নিজে উদ্যোগী হয়ে সেটা থেকে উদ্ধার পাওয়া ইত্যাদির জন্য প্রচুর সময় ও মুসিবতের হিসাবটি তাঁরা করেন না। পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত লজিস্টিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করলে নিজের হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আবার অনলাইন ক্রেতারা ইতিমধ্যে এ ধরনের সেবা প্রতিষ্ঠানের সেবাপ্রাপ্তিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ফলে আপনার পণ্য যদি তাঁরা এমন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পান, তাহলে তাঁদের আপনার প্রতি আস্থা বাড়ে বৈকি।

৩. প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি
অনলাইন বা অফলাইন প্রতিষ্ঠানের জন্য এখন প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যদিও এখন স্মার্টফোনের কারণে সবাই কমবেশি ছবি তুলতে অভ্যস্ত, তারপরও প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফির বেশ কিছু ট্রিকস অ্যান্ড টিপস রয়েছে, যা একজন পেশাদার ফটোগ্রাফারই সবচেয়ে ভালো পারেন। প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফির অনেক এজেন্সি আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। তা ছাড়া একটু খোঁজ নিলে আপনার চারপাশে অনেক বন্ধুবান্ধবকেও পেতে পারেন, যাঁরা হয়তো কোনো মিডিয়ার লাইফস্টাইল সেকশনের জন্য ছবি তোলেন। তাঁদের অনুরোধ করে চা খাইয়েও কাজটা করে নিতে পারেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি প্রতিদিনই নতুন নতুন পণ্য আপনার স্টোরে তোলেন না। কাজে মাসে দু–তিনবার এই সেবা নিলেই আপনার কাজটা সহজ হয়ে যাবে।

৪. ওয়েবসাইট বানানো ও রক্ষণাবেক্ষণ
এই সেক্টরকে বলা যায় সবচেয়ে অবহেলিত। ফেসবুক পেজের মতো নিজেই একটা ওয়েবসাইট সহজে বানানো যায় না। এ কারণে অনেকের ধারণা, এ রকম ওয়েবসাইট বানানো মনে হয় অনেক টাকাকড়ির ব্যাপার। কিন্তু বর্তমানে অনেক সহজ উপায় এবং ওয়েব ডেভেলপার রয়েছেন, যাঁরা মোটামুটি খরচে আপনাকে একটা কার্যকর ওয়েবসাইট বানিয়ে দিতে পারেন। যেহেতু এই ওয়েবসাইটের কনটেন্ট আপনি নিজে দেখাশোনা করবেন, তাই ওয়েবসাইট বানানোর সময় কোনো প্রচলিত ও জনপ্রিয় সিএমএস (কনটেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম), যেমন ওয়ার্ডপ্রেস, ব্যবহার করা ভালো। একবার বানিয়ে নেওয়ার পর, এটির রক্ষণাবেক্ষণ ও আপগ্রেডের জন্য আপনি একই ডেভেলপারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারেন।
ওয়েবসাইট আরও একটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ওয়েবসাইট না থাকলে ফেসবুক মার্কেটিংয়ের জন্য রি-টার্গেটিং অপশন আপনি ব্যবহার করতে পারবেন না।

৫. গ্রাফিক ডিজাইন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনার পণ্য ও সেবা তুলে ধরার জন্য আপনি প্রচুর ছবি ও গ্রাফিকস ব্যবহার করেন বলেই আমার ধারণা। অনেকে নিজেই এ কাজ জোড়াতালি দিয়ে সেরে নেন। সেটি কিন্তু সব সময় সুন্দর ও যথাযথ হয় না। এ ক্ষেত্রে আপনি একজন গ্রাফিক ডিজাইনারের শরণাপন্ন হতে পারেন। আপনার যদি বাজেট একটু বেশি থাকে, তাহলে আপনি একটি ছোট এজেন্সিও হায়ার করতে পারেন।

৬. কনটেন্ট রাইটার
নিজের ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেজ ইত্যাদির জন্য আপনাকে প্রচুর কনটেন্ট তৈরি করতে হয়। কমবেশি বেশির ভাগ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নিজেই এ কাজ করেন। কিন্তু একজন কনটেন্ট রাইটারের সাহায্য আপনাকে অনেকখানি এগিয়ে দেবে। দেশে অনেক ফ্রিল্যান্স কনটেন্ট রাইটার রয়েছেন। আপনি তাঁদের সাহায্য নিতে পারেন। তাঁরা আপনার পোস্টের জন্য কপি রাইটিং থেকে শুরু করে ব্লগ পোস্টও লিখে দিতে পারেন।

৭. পয়েন্ট অব সেলসের ব্যবহার
বেশির ভাগ ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তা কোনো পয়েন্ট অব সেলস (বেচাবিক্রির সফটওয়্যার) কিংবা ইনভেন্টরি সফটওয়্যার ব্যবহার করেন না। তাঁরা তাঁদের অর্ডার বেশির ভাগ সময়ই ফেসবুকের ইনবক্স, মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে পেয়ে থাকেন এবং সে মোতাবেক পণ্য ডেলিভারি করেন। কিন্তু যদি একটু সময় লাগিয়ে কাস্টমারের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর বা ই-মেইল ঠিকানা আপনি আপনার পয়েন্ট অব সেলস কিংবা ইনভেন্টরি সিস্টেমে এন্ট্রি দেন, তাহলে একদিকে আপনি যেমন সহজে বেচাবিক্রির হিসাব রাখতে পারবেন, তেমনি ভবিষ্যতের জন্য আপনার কাস্টমারদের ডেটাবেইসও তৈরি করে ফেলতে পারবেন। ইন্টারনেটে আপনি অনেক ফ্রি সফটওয়্যার পাবেন, যা দিয়ে আপনি নিজের কাজ শুরু করতে পারেন। এ ছাড়া অনেক সফটওয়্যার অ্যাজ আ সার্ভিস (সাস) রয়েছে, যা নামমাত্র মূল্যে আপনি ব্যবহার করতে পারবেন।

৮. অনলাইন অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার
একটা সময় ছিল অনেক বড় ব্যবসায়ী তাঁদের ব্যবসার সব হিসাব একটিমাত্র টালিখাতাতে লিপিবদ্ধ রাখতেন। কিন্তু এখন সেটি সম্ভব নয়। আপনার দরকার একটি হিসাবের সফটওয়্যার। এতে আপনি আপনার আয়–ব্যয়ের সব তথ্য লিপিবদ্ধ করবেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে আমার পরামর্শ হবে, আপনি প্রথমে কোনো ফ্রি অনলাইন সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন। এরপর যেকোনো সাস সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন। সফটওয়্যার নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখবেন, এ থেকে যেন আপনি আপনার মাসিক ও বাৎসরিক হিসাব সহজে বের করতে পারেন। প্রয়োজনে শুরুতে আপনি একজন আর্থিক পরামর্শকের কাছ থেকে এ ব্যাপারে সহায়তা নিতে পারেন।
এই নিবন্ধে আমি সাতটি সেবার কথা লিখেছি, যার জন্য আপনি ব্যক্তিক, প্রাতিষ্ঠানিক বা স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার ব্যবহার করে আপনার শ্রম ও সময় লাঘব করতে পারেন। এতে করে আপনি আপনার মূল কাজ তথা প্রোডাক্টের উন্নয়ন, কর্মী ব্যবস্থাপনায় অধিকতর সময় দিতে পারবেন। নতুন নতুন পরিকল্পনাও করতে পারবেন।