গরিব দেশগুলো বঞ্চিত হচ্ছে

৬৫ হাজার কোটি ডলারের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) ছাড় করেছে আইএমএফ। দুর্যোগের সময় এ ধরনের তহবিল ছাড় করে আইএমএফ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)

বিশ্বের ধনী দেশগুলো আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা থেকে সামঞ্জস্যহীনভাবে লাভবান হয়—এমন অভিযোগ নতুন নয়। চলমান কোভিড মহামারির মধ্যেও দেখা যাচ্ছে, ধনী দেশগুলো টিকদানে অন্যদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ফলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারেও তারা এগিয়ে।

এই পরিস্থিতিতে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে যেখানে সহযোগিতা করা উচিত ছিল, সেখানে দেখা যাচ্ছে উল্টো ঘটনা, আইএমএফের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস বা এসডিআরের সিংহভাগ পেয়ে যাচ্ছে ধনী দেশগুলো। এসডিআর মূলত আইএমএফের এক ধরনের মুদ্রা, যা আবার পাঁচটি মুদ্রায় রূপান্তরিত করা যায়। এটি পেলে একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে যায়। ফলে আমদানি-রপ্তানিতে সুবিধা হয়। বাংলাদেশও এসডিআরের হিস্যা পাবে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৬৫ হাজার কোটি ডলারের স্পেশাল ড্রয়িং রাইটসের অর্থ ছাড় করেছে। মূলত দুর্যোগের সময় আইএমএফ এ ধরনের তহবিল ছাড় করে থাকে। এর আগে সর্বশেষ ২০০৯ সালে আর্থিক সংকটের সময় আইএমএফ এই তহবিলের অর্থ ছাড় করেছিল।

আইএমএফের ১৯০টি সদস্যদেশের মধ্যে এই সহায়তার অর্থ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর বিতরণের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কার কত হিস্যা, তার ভিত্তিতে এই অর্থ ছাড় করা হয়েছে। এতে হয়েছে কি, এই বিপুল তহবিলের মধ্যে মাত্র ২১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার পেয়েছে নিম্ন আয়ের দেশগুলো। আর উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো পেয়েছে ২৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। আর বাকি ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি ডলার পেয়েছে ৪০টি ধনী দেশ।

এবার মহামারিজনিত মন্দার সঙ্গে ২০০৮-০৯ সালের আর্থিক সংকটের পার্থক্য হলো, সেবার ধনী দেশগুলো আক্রান্ত হলেও উন্নয়নশীল ও গরিব দেশগুলোর গায়ে আঁচ লাগেনি। কিন্তু এবার ঘটছে ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ ধনী দেশগুলো বিপুল প্রণোদনা ও টিকাদানের কল্যাণে যেখানে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে, সেখানে গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলো এখনো খাবি খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এসডিআরের মতো স্বল্প সুদের ঋণসহায়তা দরকার ছিল গরিব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর, কিন্তু দেখা গেল, এসডিআরের সিংহভাগ পেল ধনী দেশগুলো।

এ প্রসঙ্গে অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের ওয়াশিংটন কার্যালয়ের প্রধান নাদিয়া দার ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, নিম্ন আয়ের দেশগুলো যে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলার পেয়েছে তাতে উপকার হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ট নয়। তিনি আরও বলেন, ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে পার্থক্য কেবল বড়ই হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ধনী দেশগুলোর উচিত হবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর কাছে এসডিআরের অর্থ হস্তান্তর করা, আর সেটা এমনভাবে করা উচিত, যাতে তারা উপকৃত হয়।

আইএমএফের হিসাব অনুসারে, করোনাভাইরাসজনিত সংকট কাটিয়ে উঠতে আগামী পাঁচ বছরে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর প্রায় ৪৫ হাজার কোটি ডলার প্রয়োজন হবে।

চলতি বছরের জুন মাসে ধনী দেশগুলোর জোট জি–৭ গরিব দেশগুলোকে ১০ হাজার কোটি ডলার দিতে সম্মত হয়, এসডিআর ও ঋণ—উভয় পদ্ধতিতেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা উদ্যোগ নেয়নি।

তবে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা ধনী দেশগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, যেসব দেশের বেশি প্রয়োজন, এসডিআরের টাকা যেন তাদের মধ্যে পুনর্বণ্টন করা হয়।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধনী দেশগুলো এসডিআরের টাকা গরিব দেশগুলোকে দান করে দেবে, তা হওয়ার নয়। এসডিআর নগদ অর্থ নয়। এটা রিজার্ভভিত্তিক সম্পদ, নগদ অর্থের বিনিময়ে যা বিক্রি করা হয়। আর রিজার্ভ থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে। তাদের তো আর সেই ক্ষমতা নেই যে রিজার্ভের অর্থ কাউকে এমনি এমনি দিয়ে দেবে।

এখন কোনো দেশ এসডিআরের অর্থ ছেড়ে দিলে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াবে যে আইএমএফ তার জন্য যে বরাদ্দ রেখেছিল, অর্থ ছাড়ের পর ওই দেশের কাছে থাকবে বরাদ্দের চেয়ে কম। যে পার্থক্য থাকবে তার ওপর সুদ গুনতে হবে। আবার কোনো দেশ অন্য দেশের কাছ থেকে এসডিআর পেয়ে যদি কোটার চেয়ে বেশি পেয়ে যায়, তাহলে সে সুদ পাবে। এসডিআরের মেয়াদ নির্দিষ্ট নেই, ফলে দাতা দেশকে সারা জীবন ধরে সুদ গুনতে হবে।

এই সুদের হার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। তবে বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকায় এই হার দ্রুতই বেড়ে যেতে পারে, কারণ ব্যাপারটা বাজারের ওপর নির্ভরশীল।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা বলছেন, আইএমএফের দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রবৃদ্ধিবিষয়ক ট্রাস্টে ধনী দেশগুলো এসডিআরের টাকা ঋণ হিসেবে দিতে পারে। ট্রাস্ট সেখান থেকে গরিব দেশগুলোকে ঋণ দিতে পারে। এ রকম আরও অনেক কৌশলের কথা আইএমএফ এখন চিন্তা করছে। তবে সমালোচকেরা মনে করেন, এতে গরিব দেশগুলোর ঋণের বোঝা উল্টো বাড়বে। আবার এই ঋণে সুশাসনের শর্ত জুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে না।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান অফিশিয়াল মনেটরি অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস ফোরামের যুক্তরাষ্ট্রের সভাপতি মার্ক সোবেল ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ‘গরিব দেশগুলোর ঋণ নয়, দরকার ছিল অনুদান। কিন্তু এভাবে এসডিআরের অর্থ প্রবাহিত করা বা জি-৭-এর অর্থ যাবে ঋণ হিসেবে। ধারণা হিসেবে এটা খারাপ নয়, তবে যারা ঋণ নেবে, কিছুদিন পর তা ফেরত দেওয়া কষ্টকর হবে।