গল্পটা ফিলিপস নগরীর অর্থনীতির

কী নেই আইন্ডহোভেনে। বিমানবন্দর, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সবচেয়ে বড় প্রাইমার্ক শপ, দক্ষিণ ভারতীয় নিরামিষ রেস্টুরেন্ট কৃষ্ণাভিলাস, ইতালিয়ান রেস্টুরেন্ট হ্যাপি ইতালি, প্যন্ডোরা কিংবা জোয়ারস্কির দোকান, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি, ফুটবল স্টেডিয়াম, নেদারল্যান্ডসের সবচেয়ে ভালো হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা হওয়া ক্যাথারিনা হাসপাতাল, বিশ্বমানের গবেষণা ও প্রযুক্তির জন্য আলাদা করে তৈরি হাইটেক ক্যাম্পাস।

অথচ প্রায় গ্রামতুল্য এই শহরের যাত্রা শুরু হয় খেরার্ড ফিলিপসের হাত ধরে ১৮৯১ সালে। ছেলের পাশে খেরার্ডের বাবা ফ্রেডেরিক ফিলিপসও ছিলেন। বাল্ব বানানো দিয়ে শুরু হয় উৎপাদন, তৈরি হয় অসংখ্য কলকারখানা। শহরের মধ্যে আজও চিমনিসহ সে জায়গাটুকু রেখে দেওয়া আছে, তার পাশেই আছে ফিলিপসের জাদুঘর। খেরার্ড ফিলিপসের ঝোঁক ছিল পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণায়, এর জন্য তিনি আলাদা করে গবেষণাগারও তৈরি করেছিলেন।

দক্ষিণ নেদারল্যান্ডসে অবস্থিত আইন্ডহোভেন, পঞ্চম বৃহত্তর শহর হিসেবে পরিচিত, এর জনসংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। ১২৩২ সালে হেনরি আই ডুকে ব্রাবান্টের হাত দিয়ে তৈরি আইন্ডহোভেন প্রাচীন শহরের তালিকার প্রথম দিকে থাকলেও, পর্যটকদের এখানে আসার জন্য নিরুৎসাহিত করা হয়, অর্থনৈতিক দিক থেকে এই শহর প্রচণ্ড আকর্ষণীয় হলেও পর্যটকদের ঘুরে দেখার মতো এখানে তেমন কিছু নেই।

ফিলিপস–এর পুরোনো ভবন
Alex Tihonov

তবে ফিলিপসের পর ব্রেক্সিট এই শহরকে অন্য গুরুত্বে নিয়ে গেছে। অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানই ব্রেক্সিটের ঝক্কি এড়িয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে ব্যবসা করতে যুক্তরাজ্য থেকে তাদের কার্যালয় সরিয়ে নিয়েছে। অত্যধিক দামের কারণে আমস্টারডাম বা ডেনহাগের জমিজমা যেহেতু ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাই তাদের প্রথম পছন্দ হিসেবে কাজ করেছে আইন্ডহোভেন।

শহরটির ভৌগোলিক অবস্থান ও এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, বেলজিয়াম বা জার্মানি যেকোনো সীমান্তে পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র মিনিট ৪০। এতে আইন্ডহোভেনের বাড়ি, জমির বাজারও এখন আগুন। পাঁচ বছর আগে এখানে দামাদামি করে বাড়ি কেনা যেত, আর এখন এখানে নির্দিষ্ট দামের ওপরে টাকা দিয়ে বাড়ি কিনতে হয়। তাও বেশির ভাগ সময় ক্রেতা মাত্র একবার দাম বলার সুযোগ পান। অসংখ্য মানুষ বেশি দাম বলেও বাড়ি পাচ্ছেন না, দিনের পর দিন কাঙ্ক্ষিত সুযোগের জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

আইন্ডহোভেনের গল্প বলতে গেলে যে নাম ঘুরেফিরে আসবেই, সেটি হলো ‘ফিলিপস’। কথিত আছে, একসময় পুরো নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রীয় বাজেটের চেয়ে ফিলিপসের বাজেট বেশি ছিল, নেদারল্যান্ডস সরকারের যত কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করতেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ ফিলিপসে কাজ করতেন। এখনো আইন্ডহোভেন শহরে ঘুরতে যাওয়ার জায়গা, ফিলিপস জাদুঘর, ফিলিপস বাগান আর রেস্তোরাঁ। ফিলিপসের বাগান যেখানে আপেল আর পিয়ার উৎপাদিত হয়। এ ছাড়া আছে ফিলিপসের তৈরি স্টেডিয়াম, এভুলিয়ন, ফ্রিটস ফিলিপস মিউজিক সেন্টার, যেখানে ভালো সব গান আর বাজনার অনুষ্ঠানগুলো হয়। আগে ফিলিপসের কর্মীদের বাসস্থানের জন্য নিজস্ব আবাসনব্যবস্থা ছিল, অন্যান্য ব্যবসার মতো এটিও তারা নব্বইয়ের দশকে বিক্রি করে দেয়। ফিলিপসের বিভিন্ন চত্বরের ভবনগুলোতে এখন অন্য অফিস, স্কুল, রেস্টুরেন্ট, দোকান ইত্যাদি বানানো হয়েছে। কিছু কিছু ভবনকে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

আইন্ডহোভেনের গল্প বলতে গেলে যে নাম ঘুরেফিরে আসবেই, সেটি হলো ‘ফিলিপস’। একসময় পুরো নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রীয় বাজেটের চেয়ে ফিলিপসের বাজেট বেশি ছিল, নেদারল্যান্ডস সরকারের যত কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করতেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ ফিলিপসে কাজ করতেন।

একবার এক রান্নার কর্মশালায় গেছি, কর্মশালা যে জায়গাটায় হলো, সেটা ফিলিপসের পুরোনো কারখানা বনাম অফিস, যেখানে আগে পুরোদমে পণ্য উৎপাদিত হতো। অনেক অনেক আগেও নয়, এই ১০-১৫ বছর আগে। আমি নিজেও এই ভবনের নিচে একটা প্রশিক্ষণে এসেছিলাম। সবাই যখন রান্নার চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত, আমি তখন পুরো ভবনে হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছি, গায়ে অজানা অনুভূতি। শুরুর দিকে ফিলিপস মেয়েদের বাড়ির বাইরে কাজ করাকে উৎসাহ দিত না। পুরোনো ফিলিপস ভবনগুলোতে তাই কোনো মেয়েদের টয়লেট নেই, মায়েদের ব্রেস্ট পাম্প করার কোনো ঘর নেই।

অনেকবার আন্দোলনের মুখে পিছিয়ে, থেমে, ২০১৮-তে অবশেষে বিক্রি করা হয় ফিলিপস লাইটিং, ক্রেতা সিগনিফাই, তবে শর্ত, সিগনিফাই শুধু ফিলিপসের পণ্যই বিক্রি করবে (আপাতত)। কারণ, শেষ কথা বলে অর্থনীতিতে কিছু নেই, কিছুই এক জায়গায় থাকে না। আইন্ডহোভেনের অদূরবর্তী ছোট শহর মারহেইজেতে, টেলিকাস্টারে চলছে সিগনিফাইয়ের তিন মাত্রার বাতি নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বিভিন্ন মডেলের সফল উত্তীর্ণের পর এখন প্রচুর তিন মাত্রার বাতি উৎপাদিত হচ্ছে। আলো মানুষের জীবনে কী অপরিসীম ভূমিকা রাখে, তা আধুনিক আলোক ব্যবস্থা না দেখলে জানতেই পারতাম না। কারও যদি জ্যোৎস্না প্রিয় হয়, সে পুরো বাসার জন্য একধরনের আলোক ব্যবস্থা ব্যবহার করতে পারে, যার রক গান করতে ভালো লাগে সে তার মেজাজ কিংবা গানের আবহাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে পুরো বাড়িতে আলোর ব্যবস্থা রাখতে পারে। একটি মাত্র রিমোটের মাধ্যমে পুরো বাড়ির আলো নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিংবা সময় নির্ণায়ক স্থাপন করা যায়। এর বাইরেও আছে, আলোর সাহায্যে গ্রিনহাউসে চাষাবাদ, মুরগির ডিম ফোটানোর প্রকল্প, কত কী।

ফিলিপসের হাত ধরেই সূচনা হয়েছে আইন্ডহোভেনের অন্যতম আকর্ষণ হাইটেক ক্যাম্পাস, যেটাকে অনেকে প্রযুক্তির কেন্দ্র বলে। ফিলিপস চেয়েছিল বিভিন্ন জায়গায় গবেষণাগার না থেকে সব এক জায়গায় থাকুক, তাতে গবেষকদের পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরের দেখা হওয়া, চিন্তার বিনিময়, আলোচনা—সবকিছুর সুবিধা হবে। সেই লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালে এই হাইটেক ক্যাম্পাসের যাত্রা হয় শুরু। যদিও ২০১২ সালে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান র‍্যামফাসটোস ইনভেস্টমেন্টের কাছে ফিলিপস হাইটেক ক্যাম্পাসটি বিক্রি করে দেয়। ক্যাম্পাসের ভেতরে প্রায়ই নেদারল্যান্ডসের রাজপরিবারের কিংবা সরকারি গাড়ির বহর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। রাজপরিবার ও ডাচ সরকারের অতিথিদের তালিকায় দর্শনীয় স্থান হিসেবে এই স্থান থাকবেই।

খেরার্ড ফিলিপস, প্রতিষ্ঠাতা

ফিলিপসের আগে আইন্ডহোভেন বিখ্যাত ছিল সর্ববৃহৎ দেশলাই তৈরির কারখানার জন্য। এরপর ফিলিপসের বাল্বের উৎপাদন শুরু হওয়ায় আইন্ডহোভেনকে অনেকে সিটি অব লাইটও বলে থাকে। প্রতিবছর নভেম্বরে ফিলিপসের সৌজন্যে দেশ-বিদেশের শিল্পী ও ডিজাইনারদের তৈরি নতুন উদ্ভাবন নিয়ে সপ্তাহব্যাপী উৎসবটির নাম ‘গ্লো ফেস্টিভ্যাল আইন্ডহোভেন’, যেখানে কম্পিউটার, সেন্সর, অ্যানিমেশন কৌশলগুলোর মতো নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আলো দিয়ে তৈরি শিল্প এবং নকশা উপস্থাপন করা হয়। ২০০৬ সালে এই উৎসবের শুরু। এ সময় প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ ধরে আলোর শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়, সিটি সেন্টারের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে এগুলো উপভোগ করা যায়। ইঞ্জিনিয়ার, ডিজাইনার, বিজ্ঞানী এবং শিল্পীরা একত্র হয়ে নতুন নতুন ধরনের আলোর ধারণা আর প্রযুক্তি উপস্থাপন করেন।

আইন্ডহোভেনে আরেকটি উল্লেখযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হচ্ছে ‘ডাচ ডিজাইন উইক’। ২০০২ সালে ২০টি প্রতিষ্ঠান নিয়ে শুরু হওয়া উত্তর ইউরোপের এই বৃহত্তম ডিজাইন ইভেন্টে দেশ-বিদেশের ২৬ শ-এর বেশি ডিজাইনারের কাজ এবং তাঁদের চিন্তা ও কল্পনাগুলো উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবছর অক্টোবরে ৯ দিনের এই ডাচ ডিজাইন উইক শহরজুড়ে প্রায় ১২০টি স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সারা আইন্ডহোভেন সাজানো হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রঙিন পোস্টারে।
একসময় হাতে গোনা কয়েকটি বাংলাদেশি পরিবারের বাস ছিল আইন্ডহোভেনে। এএসএমএল, এনএক্সপি, আইন্ডহোভেন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি, ফন্টিস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ইত্যাদির কারণে আইন্ডহোভেন শহরে এখন প্রচুর বাংলাদেশির বাস। রাস্তায়-দোকানে হরদম বাংলা কথা শোনা যায়। খুব দ্রুতই একটি শিক্ষিত বাংলাদেশি সমাজ গড়ে উঠছে আইন্ডহোভেনে।