গাড়ির দাম এত কেন

‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’—এই ছড়া ছোটবেলায় কে না শুনেছে। একটি গাড়ির স্বপ্ন দেখতে দেখতেই এ দেশের কিশোর-তরুণেরা বড় হয়। কর্মজীবনে প্রবেশ করে সেই স্বপ্ন আরও ডানা মেলতে শুরু করে। কিন্তু যখন গাড়ি কিনতে যান, তখন হতাশ হন। গাড়ির দামের সঙ্গে স্বপ্নের যোগসূত্র স্থাপন হয় না। শুল্ক-করের কারণেই দেশে গাড়ির দাম তুলনামূলক বেশি। নতুন গাড়ির বদলে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির কিনতে গেলেও পরিস্থিতি খুব বেশি অনুকূলে থাকে না। নতুন গাড়ির চেয়ে পুরোনো গাড়ির দাম কিছুটা কম হলেও তা অনেক সময় হাতের নাগালে থাকে না।

নতুন ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ি—এই দুই ধরনের গাড়ি বিক্রি হয়। তবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের কাছে রিকন্ডিশন্ড গাড়িই বেশি পছন্দ। বর্তমানে প্রায় ৭৫ শতাংশ রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দখলে দেশের গাড়ির বাজার। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি অনেকটা পুরোনো গাড়ির মতো। এসব গাড়ি জাপানে এক থেকে পাঁচ বছর চলার পর বাংলাদেশে আসে। নতুন গাড়ির তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় বাজার দখল করে আছে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি। তবে ইদানীং নতুন গাড়ির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে ক্রেতাদের।

শুল্ক-কর একটি গাড়ির দাম কত বাড়িয়ে দিতে পারে, তার একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নতুন ও পুরোনো সব গাড়ির আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ও আগাম ভ্যাট ৫ শতাংশ করে বসে। মূলত সম্পূরক শুল্ক–করই গাড়ির দাম বাড়িয়ে দেয়। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ১৬০০ সিসি পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক ৪৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে ১৬০০ সিসি পর্যন্ত একটি রিকন্ডিশন্ড কারের করভার পড়ে ১৩০ শতাংশ। এর মানে অবচয় সুবিধার পর কোনো গাড়ির শুল্কায়নযোগ্য মূল্য বা এসেসভ্যালু যদি ১০০ টাকা হয়, তবে এই গাড়ি বন্দর থেকে খালাস করতে আরও ১৩০ টাকা লাগবে। ১০০ টাকার গাড়ি বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করলে দাম হয়ে যায় ২৩০ টাকা। ১৬০০ সিসি পর্যন্ত নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে করভার ৯১ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার নতুন গাড়িতে ৯১ টাকা শুল্ক-কর দিতে হয়।

আবার ৪০০০ সিসির বেশি রিকন্ডিশন্ড গাড়িতে সব মিলিয়ে করভার ৮৩৬ শতাংশ। এসব গাড়ির সম্পূরক শুল্ক ৫০০ শতাংশ। এর মানে, দামি ও বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিনের গাড়ির দাম ১০০ টাকা হলে ৮৩৬ টাকা শুল্ক-কর দিতে হবে। বিদেশে ১০০ টাকার গাড়ির দাম বাংলাদেশে আসার পর হয়ে যাবে ৯৩৬ টাকা। একইভাবে ৩০০০ সিসি থেকে ৪০০০ সিসি পর্যন্ত নতুন গাড়ির করভার ৫২৬ শতাংশ।

রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ভিন্ন পন্থায় হিসাব করা হয়। জাপান সরকার বছরভিত্তিক প্রতিটি গাড়ির উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য ঘোষণা করে ইয়েলো বুক প্রকাশ করে। সেই ইয়েলো বুকের মূল্য ধরে পাঁচ বছর পর্যন্ত অবচয়ন সুবিধা দেওয়া হয়। ইয়েলো বুক ধরে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য বেশি হয়। জানা গেছে, বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা নিলামের মাধ্যমে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি কেনেন। যেমন ইয়েলো বুকে একটি গাড়ির মূল্য যদি সাড়ে ৮ লাখ টাকা বা প্রায় ১০ হাজার মার্কিন ডলার হয়, তবে নিলামে ওই গাড়ি তিন-চার হাজার ডলারে কেনেন আমদানিকারকেরা। ফলে কম দামে গাড়ি কিনলেও বেশি দাম ধরে শুল্ক-কর দিতে হয়। এ কারণে গাড়ি ব্যবসায়ীরা নিলামে কেনা দামে গাড়ির শুল্কায়নের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।

আবার নতুন গাড়ির ক্ষেত্রে নিয়ম অন্য রকম। গাড়ি নির্মাতার কাছ থেকে যে দামে গাড়ি কেনা হয়, সেই দামের ভিত্তিতেই শুল্ক-কর বসে। বাংলাদেশের একশ্রেণির গাড়ি ব্যবসায়ীরা অন্য পন্থায় শুল্ক-কর এড়িয়ে যান। যেমন ২০ হাজার ডলারে গাড়ি কিনলেও নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০ হাজার ডলার দামের সনদ নিয়ে আসেন। শুল্ক-কর কর্মকর্তারা সেই দাম ধরেই শুল্কায়ন করেন। এসব কারণেও নতুন ও পুরোনো গাড়ির দামের পার্থক্য কমে আসছে।

জানতে চাইলে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারক ও পরিবেশক সমিতির (বারভিডা) সাবেক সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন প্রথম আলোকে বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে গাড়ির ওপর এত শুল্ক-কর নেই। সরকার যদি শুল্ক-কর কমায়, তাহলে এ দেশে গাড়ি আসবে। মধ্যবিত্তরা গাড়ি কিনতে উৎসাহিত হবেন। গাড়ি এখন বিলাসী পণ্য নয়। ঢাকা শহরের বাইরে অন্য শহরগুলোতে সামর্থ্যবান মধ্যবিত্ত আছে। তাঁরাও গাড়ি কিনতে উৎসাহিত হবেন। এ ছাড়া দেশে অনেক চার লেন, ছয় লেনের সড়ক, ফ্লাইওভার হচ্ছে। সড়কে গাড়ি বেশি হলেও সমস্যা নেই।

গাড়ি আমদানিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পাঁচ বছর আগে বছরে ৭০০ থেকে ১ হাজার নতুন গাড়ি আমদানি হতো। করোনার আগে পর্যন্ত বছরে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার গাড়ি আমদানি হয়েছে। ২০২০ সালে আড়াই হাজারের মতো নতুন গাড়ি আমদানি হয়েছে।

বাজারে গাড়ির দাম কেমন

রিকন্ডিশন্ড কিংবা পুরোনো গাড়ি দিয়েই বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তের গাড়ি চড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়। ভালো বেতনের চাকরি করে, এমন মধ্যবিত্ত দামি ও নতুন গাড়ির বদলে রিকন্ডিশন্ড গাড়িতেই বেশি আগ্রহী। জাপানের টয়োটা কোম্পানির রিকন্ডিশন্ড গাড়ির চাহিদায় এ দেশে সবচেয়ে বেশি। দেশে বেশি বিক্রি হয়, এমন গাড়ির তালিকায় আছে টয়োটা করোলা, ফিল্ডার, প্রিমিও, এক্সিও, এলিয়ন মডেলের গাড়ি। এসব গাড়ি ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৩০ লাখ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। এ ছাড়া টয়োটার রিকন্ডিশন্ড গাড়ির যন্ত্রাংশের বিশাল বাজারও তৈরি হয়েছে। ফলে গাড়ির মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তুলনামূলক সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য।

মিতসুবিশি, নিশান, হোন্ডা, হুন্দাই, টাটাসহ বিভিন্ন কোম্পানির নতুন গাড়ি বিক্রি হয়। নিশানের এক্স-ট্রেইল গাড়ি মডেলভেদে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। হোন্ডার ভেজেল মডেলের গাড়িও বেশ চলছে। হোন্ডা ভেজেল গাড়ির দাম গড়ে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের দিকে যেসব গাড়ি তৈরি হয়েছে, সেগুলোর দাম তুলনামূলক কম। এদিকে মিতসুবিশি পাজেরো ও ল্যান্সার মডেলের গাড়ি তুলনামূলক বেশি বিক্রি হয়।