চট্টগ্রামে টিকে আছে শত বছরের হালখাতা ব্যবসা

প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আধুনিক হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হিসাব রাখার পদ্ধতি। তবু কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কল্যাণে টিকে আছে হালখাতা ব্যবসা।

পয়লা বৈশাখে পুরোনো সব হিসাব নতুন করে তোলা হয় লাল রঙের এই নতুন হালখাতায়। পয়লা বৈশাখ ঘনিয়ে আসায় এই খাতা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিক–কর্মচারীরা। সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরের টেরিবাজার এলাকায়
ছবি: সৌরভ দাশ

কোনোটি মোড়ানো লাল কাপড়ে, কোনোটি সবুজ, নীলে। চ্যাপ্টা, মোটা—নানা আকারের এসব খাতাকে ব্যবসায়ীরা ডাকেন নানা নামে। হালখাতা, সালুখাতা, লাল খাতা যে নামেই ডাকুক, এসব খাতায় লেখা হয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিদিনকার জমা-খরচের হিসাব। আর তার সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির ঐতিহ্য।

চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লা, বক্সিরবিট, টেরিবাজার এসব খাতা বেচাকেনার পরিচিত জায়গা। আন্দরকিল্লা থেকে লালদীঘি সড়ক ধরে নেমে যেতে যেতে চোখে পড়বে হাতে গোনা চার–পাঁচটা হালখাতার দোকান। সেসব দোকানের একটি কর্ণফুলী আর্ট অ্যান্ড বাইন্ডিং হাউস। হালখাতার ব্যবসার সঙ্গে এ নামটা জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। ১২০ বছর ধরে এ ব্যবসায় জড়িত প্রতিষ্ঠানটি। শহরের সবচেয়ে পুরোনো হালখাতার দোকানগুলোর একটি এটি। শতবর্ষে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আধুনিক হয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হিসাব রাখার পদ্ধতি। কাগজ-কলমের জায়গা দখল করেছে কম্পিউটার-সফটওয়্যার। কিন্তু কর্ণফুলী আর্ট অ্যান্ড বাইন্ডিং তার ব্যবসার শিকড় গেঁথে রেখেছে শতবর্ষী বটবৃক্ষের মতো।

প্রতিষ্ঠানটির শুরু প্রয়াত অশ্বিনীকুমার দাশের হাত ধরে, ১৯০২ সালে। মাত্র পাঁচ-ছয়জন কারিগর নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। শুরুতে বেচাকেনা তেমন ছিল না। ধাপে ধাপে ব্যবসা বেড়েছে। অশ্বিনী দাশের মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠানটির ভার এসে পড়ে তাঁর ছেলে কৃষ্ণ কুমার দাশের কাঁধে। বাবার ব্যবসা ধরে রাখার পাশাপাশি বড় করেন দোকান। তাঁর মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন ছেলে পঙ্কজ দাশ। এখন তাঁদের দোকানে কারিগর আছেন সাত-আটজন। বেচাকেনাও ভালো চলছে।

পঙ্কজ দাশ জানান, একসময় খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, পাহাড়তলীসহ নগরের বিভিন্ন বনেদি ব্যবসায়ী, স্বর্ণের দোকানদার ও ফলমন্ডির আড়তদারেরা লাল কাপড়ে মোড়ানো হালখাতায় ব্যবসার হিসাব রাখতেন। কিন্তু প্রযুক্তির বিকাশের ফলে কেউ কেউ হালখাতার বদলে ব্যবহার করছেন কম্পিউটার। তারপরও এখনো অনেক ব্যবসায়ীর হিসাব-নিকাশ চলে হালখাতায়। বর্তমানে এ খাতার ব্যবহার বেশি করেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী, মুদি দোকানি ও আড়তদারেরা।

হালখাতার ভবিষ্যৎ নিয়ে পঙ্কজ দাশ বললেন, হালখাতায় টুকে রাখা হিসাব চাইলেই ঘষামাজা করে বদলে ফেলা যায় না। এ ছাড়া এখনো দেনাদার ও পাওনাদারেরা কাগজে লেখা হিসাব প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন।

আসলেই তাই। বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে এই হালখাতা। সাধারণত দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্প্রতি ও বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটে হালখাতার মাধ্যমে। এখনো চৈত্রের শেষ দিন এবং পয়লা বৈশাখে হালখাতা উৎসবের আয়োজন করা হয় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে।

মোবারক হোসেনের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে উৎসব, নববর্ষ’, সাদ উর রহমানের ‘উৎসবের ঢাকা’সহ একাধিক বই থেকে জানা যায়, মোগল আমলে খাজনা আদায় করা হতো হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে। কিন্তু হিজরি বর্ষপঞ্জি চন্দ্র মাসের হিসাবে চলার কারণে কৃষি খাজনা আদায়ে অসুবিধা হতো। এই অসুবিধা দূর করতে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করেন।

চট্টগ্রাম নগরের দুই নম্বর গেট এলাকার সোনা ব্যবসায়ী গৌরাঙ্গ দেব বলেন, পয়লা বৈশাখে তাঁরা নতুন করে হিসাবের খাতা খোলেন। এ রীতি গত ২৯ বছর ধরে মেনে চলছেন তিনি।

তবে বকশিবিট এলাকার হালখাতা ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের মতো জৌলুশ নেই এ ব্যবসায়। করোনার পর ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলে কাগজের দামও বেড়ে গেছে। মানভেদে এখন এক রিম (৫০০ কেজি) কাগজ ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। করোনার আগে এ দাম ছিল ৭৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা।

বকশি বিটের ভেতরে ঢুকতেই আরও একটি দোকানের খোঁজ মিলল। এটিও প্রায় ৮০ বছরের পুরোনো দোকান। নাম নিউ খাতাঘর। একটা দোকান দিয়ে ব্যবসা শুরু তাদের। এখন চারটি দোকান। দাদুর হাত থেকে ব্যবসার ভার এখন নাতির হাতে। দোকানের বর্তমান স্বত্বাধিকারী নয়ন ঘোষ বলেন, ৫০ থেকে শুরু করে ৬০০ টাকা দামের হালখাতা বিক্রি করছেন তারা। অনেকেই লাল রংটাকে সৌভাগ্যের বিষয় হিসেবে দেখে। এ কারণে লাল রঙের হালখাতাই বেশি বিক্রি হয়।

প্রান্ত বণিক নামের এক ক্রেতা ২০০ টাকায় একটি হালখাতা কিনছিলেন তাঁর দোকান থেকে। হাজারি গলির একটি স্বর্ণের দোকানে কাজ করেন প্রান্ত। জানালেন, বৈশাখের আগেই তাঁরা নতুন খাতা কিনে নেন।

হালখাতার ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার কারণে ব্যবসায় যে মন্দা নেমে এসেছিল, এ বছর সেই মন্দা কাটিয়ে কিছুটা সুবাতাস বইছে। গত দুই বছরের চেয়ে বিক্রি তাই বেশ ভালো।