চামড়ার অস্থায়ী আড়ত নিয়ে ক্ষোভ

রাজধানীর পোস্তায় পশুর চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
ছবি: সাজিদ হোসেন

দেশে কাঁচা চামড়ার সবচেয়ে বড় আড়ত রাজধানীর লালবাগের পোস্তা এলাকা। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী পোস্তা ঈদুল আজহার দিন দুপুর থেকে জমজমাট হয়ে ওঠে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে অন্যবারের তুলনায় এ বছর পোস্তায় কাঁচা চামড়া তুলনামূলকভাবে কম এসেছে। সে জন্য সাভারের হরিণধরায় চামড়া শিল্পনগরের পাশেই অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা আড়তগুলোকে দায়ী করছেন চামড়া খাতের মালিকেরা।

এদিকে গতবারের চেয়ে এবার গরুর কাঁচা চামড়ার দর কিছুটা বাড়লেও ছাগলের কাঁচা চামড়ার দাম নিয়ে ছিল হতাশা। রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেকে ছাগলের কাঁচা চামড়ার দাম না পেয়ে বিনা পয়সায় রেখে গেছেন। কেউ নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।

গতকাল বুধবার দেশের সবচেয়ে বড় চামড়ার আড়ত রাজধানীর পোস্তা এলাকায় ঘুরে মৌসুমি ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্যবারের তুলনায় এ বছর পোস্তায় কাঁচা চামড়া কম এসেছে। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেছেন, ঢাকা ও এর আশপাশে অস্থায়ীভাবে অবৈধ অনেক আড়ত গড়ে উঠেছে। এসব আড়তের বৈধতা নেই। তা ছাড়া গত দুই বছরের মতো এবারও কাঁচা চামড়ার দাম মিলবে না, এমন আশঙ্কা থেকে অনেকে চামড়া বিক্রির চেষ্টা না করে মসজিদ, মাদ্রাসায় ও পঞ্চায়েতে দান করে দিয়েছেন। তাই পোস্তায় চামড়া এসেছে কম।

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান প্রথম আলোকে বলেন, হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরের পাশে বিচ্ছিন্ন ও অপরিকল্পিতভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো অনেক আড়ত গড়ে উঠেছে। এগুলো কারও কাছ থেকে অনুমোদনও নেয়নি। রাজধানীতে অস্থায়ী হাট বসিয়ে চামড়া কেনা হচ্ছে। সে কারণে এবার পোস্তায় কাঁচা চামড়া কম এসেছে। তিনি বলেন, কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পদ্ধতি আছে। পোস্তায় যেটা শত বছরের ঐতিহ্য। সরকারের অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা করে সবাই। কিন্তু অন্য এলাকায় যেসব আড়ত গড়ে উঠেছে, সেসবের অনুমোদন নেই। টিপু সুলতান বলেন, ‘এসব অবৈধ আড়ত গুঁড়িয়ে দিতে আমরা শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু ফল পাওয়া যায়নি।’

এদিকে সাভার চামড়াশিল্প নগরে সরেজমিন দেখা গেছে, চামড়াশিল্প নগরে ঢোকার আগে হরিণধরা বাজরে অন্তত ৬৫টি আড়ত আছে। রাস্তার দুই পাশে এসব আড়ত গত এক বছরের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে। এবার এই প্রথম সেখানে চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব ও কলাবাগান এলাকায় কাঁচা চামড়া কিনতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও চামড়াশিল্প নগরের পাশে লাগোয়া এমন আড়ত নেই। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব আড়ত চামড়াশিল্পের পরিবেশ নষ্ট করছে। আমরা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের মানসনদ পাওয়ার চেষ্টা করছি। তারা যদি এসে দেখে চামড়াশিল্প নগরের পাশে অবৈধভাবে আড়ত গড়ে উঠেছে, তাহলে মানসনদ পাওয়া কঠিন হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব আড়ত উচ্ছেদ করতে আমরা শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। কিন্তু কিছু হয়নি।’

তবে আড়ত গড়ে তোলার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে হরিণধরা বাজারের সভাপতি আবুল বাসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চামড়া রক্ষার জন্য আমরা আড়ত দিয়েছি। দিন দিন আমাদের আড়তের চাহিদা বাড়ছে। পোস্তা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে হেমায়েতপুরে নিয়ে আসা অনেক কঠিন। সময়ও লাগে বেশি। আমাদের আড়ত থেকে চামড়া সংগ্রহ করে ট্যানারিতে নিতে সময় লাগবে পাঁচ মিনিট।’ তিনি বলেন, ‘গত দুই বছর মানুষ চামড়ার দাম পায়নি। চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আমরা অস্থায়ী আড়ত দিয়েছি।’

সাভার চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প পরিচালক জিতেন্দ্রনাথ পাল প্রথম আলোকে বলেন, এসব আড়ত কারও অনুমতি ছাড়াই দেওয়া হয়েছে। ট্যানারির মালিকেরা আমাদের কাছে অভিযোগ করেছে। এসব আড়ত সরানোর দাবি করেছে। তবে জমি যেহেতু আমাদের নয়, আমরা তাদের উচ্ছেদ করতে পারি না। এটা উচ্ছেদ করবে ঢাকা জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়। অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা আড়তের কারণে শিল্পনগরে যাওয়ার রাস্তায় যানজট তৈরি হচ্ছে।

বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ জানালেন, অস্থায়ী এসব আড়ত অনুমোদন নেয়নি।

সংরক্ষণের জন্য চামড়া প্রস্তুত করা হচ্ছে।
ছবি: সাজিদ হোসেন

এদিকে গতকাল চামড়ার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ছাগলের কাঁচা চামড়ার দাম মেলেনি। অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ীকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। নুরুল করিম হাফিজিয়া মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষক আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, ১৮টি ছাগলের কাঁচা চামড়ার দাম হিসেবে তাঁর হাতে ২০০ টাকা ধরিয়ে দিয়েছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। সে হিসাবে প্রতি পিস কাঁচা চামড়ার দাম পড়েছে ১১ টাকা। অথচ সরকার ছাগলের কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা। মমতাজ আহমেদ নামের একজন জানালেন, তিনি ছাগলের কাঁচা চামড়া বিনা পয়সায় ছেড়ে দিয়ে এসেছেন পোস্তায়। কেউ প্রতি পিস ১০ টাকা কেউ ১৫ টাকা করে বিক্রি করেছেন।

অন্যদিকে সরকার লবণজাত কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও কোরবানির পশুর রক্তমাখা চামড়ার দাম নির্ধারণ করেনি। ফলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যাঁর কাছ থেকে যে দামে পেরেছেন কিনেছেন। তবে গত দুই বছরের তুলনায় এবার কাঁচা চামড়ার দাম কিছুটা বেড়েছে। চামড়াপ্রতি গতবারের চেয়ে ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেশি বিক্রি হয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বড় আকারের গরুর কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে ৬০০ থেকে ৯০০ টাকায়। মাঝারি মানের চামড়া বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর ছোট মানের চামড়া বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ৪০০ টাকায়।