চায়ের বাজারে নতুন ‘সাদা সোনা’

চলতি ২০২০-২১ নিলাম মৌসুমে প্রথমবারের মতো সাদা চা বিক্রির জন্য তোলা হয়। একবার সর্বোচ্চ দাম ওঠে ৬ হাজার টাকা কেজি।

চায়ের বাজারে ক্রমেই সোনার মতো দামি হয়ে উঠছে সাদা চা। এ কারণে চা ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা এ চায়ের নাম দিয়েছেন ‘সাদা সোনা’। সর্বশেষ ৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নিলামে প্রতি কেজি সাদা চায়ের দাম উঠেছে ৫ হাজার ১০ টাকা, এটিই এখন পর্যন্ত নিলামে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দাম। এর আগে গত আগস্টে নিলামে এ চায়ের প্রতি কেজির সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ৬ হাজার টাকা।

চা-বাগান ও চা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি নিলাম মৌসুমেই (২০২০-২১) প্রথমবারের মতো সাদা চা বিক্রির জন্য নিলামে ওঠানো হয়েছে। চলতি মৌসুমে প্রথম এ চা নিলামে তোলা হয় গত ২৭ জুলাই। তখন সরকারি মালিকানাধীন ন্যাশনাল টি কোম্পানি তাদের চাম্পারাই বাগানের ১০ কেজি সাদা চা চট্টগ্রামের নিলামের বাজারে বিক্রির জন্য তুলেছিল। প্রথম সেই নিলামে এ চা প্রতি কেজি আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এর পরের মাসেই পুনরায় নিলামে তোলা হয় একই বাগানের সাদা চা। আগস্টের সেই নিলামে এ চা প্রতি কেজি ৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। চট্টগ্রামের আরিয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান নিলামে চার কেজি চা কিনেছিল।

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে চায়ের রাজধানীখ্যাত শ্রীমঙ্গলে অনুষ্ঠিত নিলামে যে সাদা চা বিক্রি হয়, সেটি ছিল হবিগঞ্জের বৃন্দাবন চা-বাগানের। বাগানের ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন খানের হাতে তৈরি তিন কেজি সাদা চা বিক্রি হয়েছে এবারের নিলামে। প্রতি কেজি ৫ হাজার ১০ টাকা করে কিনেছেন শ্রীমঙ্গলের সেলিম টি হাউসের মালিক মো. জামাল আহমেদ। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে সেই চা আবার চারজন ক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাও প্রতি কেজি ৭ হাজার টাকায়।

জানতে চাইলে জামাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রীমঙ্গলে দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক ঘুরতে আসেন। তাঁরা প্রায়ই এই চায়ের খোঁজ করেন। শ্রীমঙ্গল চায়ের রাজধানী হলেও সাদা চা এখানে খুব বেশি তৈরি হয় না। তাই এবারের নিলামে পাওয়ামাত্র কিনে নিয়েছি।’

এদিকে নামে সাদা হলেও এ চা দেখতে পুরোপুরি সাদা নয়। আবার এটি তৈরির প্রক্রিয়াটিও সাধারণ চায়ের উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে মেলে না। চা-গাছের একটিমাত্র উদীয়মান কুঁড়ি থেকে তৈরি হয় সাদা চা। নবীন সেই কুঁড়ি যখন শুকানো হয়, দেখতে লাগে রুপালি একটি সুচের মতো। তাই এটি ‘সিলভার নিডল টি’ হিসেবেও পরিচিত। এ চায়ের লিকার হয় হালকা সোনালি, ঠিক সাদা সোনার মতো। গাছের বর্ধনশীল অংশের কুঁড়ি থেকে তৈরি বলে এ চায়ে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে।

স্বাদ ও গুণগত মানের কারণে সাদা চা ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে দেশে। এ কারণে এ চায়ের চাষও বাড়ছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রথম সাদা চা তৈরি হয় প্রায় এক দশক আগে, পঞ্চগড়ে কাজী অ্যান্ড কাজীর চা-বাগানে। তাদের উৎপাদিত সেই সাদা চা বিদেশে রপ্তানি হয়। কাজীর পর চট্টগ্রামের হালদা ভ্যালি ২০১৭ সালে সাদা চা উৎপাদন শুরু করে। তবে এই দুই বাগানের সাদা চা নিলামে তোলা হয়নি এত দিন। এ মৌসুমেই প্রথম সাদা চা নিলামে তোলে ন্যাশনাল টি। আর সর্বশেষ নিলামে বিক্রি হয়েছে নাসির উদ্দিন খানের হাতে তৈরি বৃন্দাবন চা-বাগানের সাদা চা।

জানতে চাইলে বৃন্দাবন চা-বাগানের ব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘করোনার কারণে নিলামে চায়ের দাম বেশ পড়ে গিয়েছিল। বড় কোম্পানিগুলো এই ক্ষতি সামলে উঠলেও ছোট চা-বাগানগুলোর পক্ষে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা ছিল বেশ কঠিন। ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হলে হয় পরিমাণে বেশি বিক্রি করতে হবে, নয়তো উচ্চ মানের দামি চা তৈরি করতে হবে। সেই লক্ষ্যে খোঁজ নিতে গিয়ে ইউটিউবে দেখলাম ভারতের এক চা-বাগানের সাদা চা নিলামে প্রতি কেজি ৭৫ হাজার রুপিতে বিক্রি হয়েছে। সেটি দেখে দেশেও আমরা সাদা চা বানানো শুরু করি।’

নাসির উদ্দিন জানান, সাদা চায়ের জন্য শুধুই কুঁড়ি তুলতে হয়। এক কেজি কুঁড়ির জন্য ১০ একর জমির চা-গাছের পাতা লাগে। এরপর সেই কুঁড়ি শুকাতে হয় বিশেষ পদ্ধতিতে। সেই কাজই নিজ হাতে করেন নাসির উদ্দিন। তাঁর মতে, বাংলাদেশি চা বিশ্বমানের, ঠিকঠাকভাবে তৈরি করতে পারলে বিশ্ববাজারেও বাংলাদেশের সাদা চা বড় জায়গা করে নেবে।

চা-বাগানমালিক ও ব্যবসায়ী সূত্রে জানা গেছে, দেশে গত বছর ৮ কোটি ৬৩ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে সাদা চায়ের পরিমাণ ছিল প্রায় দেড় হাজার কেজি। পরিমাণে কম হলেও দাম বেশি হওয়ায় এই চা তৈরিতে আগ্রহ বাড়ছে বাগানমালিকদের।