চোরাচালান বেড়ে চকলেট আমদানি বন্ধ!

যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় চকলেট আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। তার পরও দেশীয় বাজার এখন বিদেশি চকলেটে সয়লাব।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাই সিন্ডিকেট সীমান্তের নানা চোরাই পথে এসব চকলেট আনছে। পরে জনপ্রিয় নানা ব্র্যান্ডের এসব দামি চকলেট ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের আনাচকানাচের বাজারে।
বেনাপোল কাস্টম হাউস সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোল বন্দর দিয়ে গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে চার কোটি নয় লাখ টাকা মূল্যের ৩৪৭ দশমিক ৮৮ মেট্রিক টন, ২০১০-১১ অর্থবছরে দুই কোটি ৫৪ লাখ টাকায় ১৮৭ দশমিক ৮৫ টন, ২০১১-২০১২ অর্থবছরে মাত্র ৩৯ লাখ টাকায় ৯ দশমিক ১ টন, ২০১২-১৩ সালে ১৬ দশমিক ৭৪ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে (মার্চ পর্যন্ত) ১৪ দশমিক ৬ টন চকলেট আমদানি হয়েছে।
ঢাকার কল্লোল গ্রুপ অপ কোম্পানিজ লিমিটেড ভারতীয় চকলেটের বাংলাদেশে একমাত্র আমদানিকারক। এই কোম্পানি দুই বছর ধরে চকলেট আমদানি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
কল্লোল গ্রুপ অপ কোম্পানিজের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতীয় ক্যাটবেরি চকলেটের বাংলাদেশে একমাত্র ডিলার হচ্ছে কল্লোল গ্রুপ। ১৫৪ থেকে ১৬০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে ভারত থেকে চকলেট আমদানি করতে হয়। একটি চকলেট আমদানি করতে যে খরচ হয়, তার চেয়ে কম দামে চোরাই পথে আনা চকলেট বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে বৈধ পথে আনা পণ্য চোরাই পণ্যের কাছে মার খাচ্ছে। তাই চকলেট আমদানি করতে আমরা উৎসাহ হারিয়েছি।’
জহিরুল ইসলাম জানান, ২০০৯-১০ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে শুধু চকলেট আমদানি থেকে সরকারকে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা রাজস্ব দেওয়া হয়েছে। এখন চোরাই পথে চকলেট বেশি করে আসায় বৈধ আমদানি কমে গেছে। এতে সরকারের রাজস্ব কমছে।
চকলেটের মতো ভারতীয় শাড়ি, থ্রি-পিচ, প্রসাধনসামগ্রী, ইমিটেশন গয়না, জিরা-মসলাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের আমদানি বেনাপোল বন্দর দিয়ে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে বলে বেনাপোল কাস্টম সূত্রে জানা গেছে।
চোরাকারবারিরা পণ্য আনতে সীমান্তে যাওয়ার আগেই বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশন, গাতিপাড়া ও নাভারণ মোড় থেকে আগেই পুলিশের পাস স্লিপ পেয়ে যাচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থা ও চোরাকারবারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই হাজার টাকা পণ্যের জন্য ২০ টাকা দামের স্লিপ কিনতে হয়। দামি পণ্যের ক্ষেত্রে আবার স্লিপের দামের হেরফের হয়। পণ্যের সংকেত হিসেবে স্লিপে ঢোল, মানুষসহ বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের ছবি দেওয়া আছে। কয়েকজন লোক রাস্তার ওপরই এসব স্লিপ বিক্রি করেন।
শার্শা উপজেলা কৃষক লীগের সদস্য মোহম্মদ আলী রেলওয়ে স্টেশনের চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করেন বলে জানা গেছে। তাঁর কয়েকজন লোক ওই স্লিপ দেওয়ার কাজ করেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোহম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন ওসব ছেড়ে দিয়েছি। ওসব কোনো কিছুর সঙ্গে নেই। এক বন্ধুর সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসার সঙ্গে আছি। গিয়াস, শাহজাহানেরা ওসব স্লিপের কাজ করে।’
ওই স্লিপের টাকা কয়েক পকেট ঘুরে পুলিশের হাতে যাচ্ছে। চোরাচালানিদের একটি সূত্রে জানা গেছে, চোরাচালানি ঘাট থেকে পুলিশ ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে মাসে এক কোটি ২০ লাখ টাকার অবৈধ লেনদেন হয়।
সম্প্রতি বেনাপোল কমিউটার ট্রেনে উঠে দেখা গেছে, সকালে খুলনা, নওয়াপাড়া, যশোর ও ঝিকরগাছা থেকে মাঝবয়সী নারী-পুরুষ ট্রেনে চড়ে বেনাপোল ও নাভারণ রেলস্টেশনে নেমে চোরাই পণ্য নিয়ে দুপুরে ফিরতি ট্রেনে তারা গন্তব্যে ফিরে যায়।
ট্রেনের বগির ভেতরে রেলওয়ে পুলিশের দুই সদস্য ঘুরে ঘুরে চোরাচালানিদের কাছ থেকে বস্তাপ্রতি ৩০ টাকা করে তুলতে দেখা গেছে। পুলিশের পোশাক পরা আফতাব ও আকবর নামের দুজন ওই টাকা তোলেন।
কত টাকা উঠল, জিজ্ঞাসা করলে রেলওয়ে পুলিশের খুলনা থানার কনস্টেবল আকবর থতমত খেয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাহ্, টাকা আর কই। এখন মাল তেমন আসছে না। দেখলেন না, ট্রেন ফাঁকা।’
চোরাচালানিদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে কথা হয় রেলওয়ে পুলিশের খুলনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোল্লা আফজাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাবিলদার আফতাব আর কনস্টেবল আকবরের বিরুদ্ধ টাকা নেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, এ জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চোরাই পণ্যের ‘তেরোঘর’: বেনাপোল সীমান্তে ইছামতী নদীর এপারে বাংলাদেশ, ওপারে ভারত। এপারে সোয়া দুই একর ভূখণ্ডে আটঘর ভারতীয় নাগরিকের বসতি। অতীতে এখানে তেরো ঘর মানুষের বসবাস ছিল বলে জায়গাটি তেরোঘর নামে পরিচিত।
তেরোঘরের পশ্চিমে ইছামতী নদী। উত্তর-দক্ষিণে ৬০০ থেকে ৭০০ গজ দূরত্বে বিজিবির সীমান্ত পাহারার দুটি চৌকি (পোস্ট)। পূর্ব দিকে সীমানা পিলার দিয়ে ভারতীয় অংশ চিহ্নিত করা। সেখানে কাঁটাতারের বেড়া বা পাহারার ব্যবস্থা নেই। ত্রিভুজ আকৃতির এই ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব পাশে বেনাপোল ইউনিয়নের গাতিপাড়া ও বড় আঁচড়া গ্রাম। আর দক্ষিণের পুটখালী ইউনিয়নের দৌলতপুর ও পুটখালী সীমান্ত।
তেরোঘরের বাসিন্দাদের বাজার সদাই, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, চিকিৎসাসহ যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে নৌকা নিয়ে তাদের নদীর ওপারে ভারতে যেতে হয়। ফেরার সময় তারা নৌকার পাটাতনের নিচে করে অস্ত্র, ফেনসিডিল, গাড়ির যন্ত্রাংশ, জিরা-মসলা, বিভিন্ন ধরনের চকলেটসহ ভারতীয় সব চোরাই পণ্য এনে তেরোঘরে মজুত করে রাখে৷ পরে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশের গাতিপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ঢোকানো হয়।
এ ব্যাপারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ২৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিজিবি সদস্যরা টাকা নিয়ে পণ্য ঢুকতে সহায়তা করে, এ অভিযোগ সত্য নয়। তবে চোরাচালানিরা একটি সংঘবদ্ধ চক্র। তেরোঘর ভারতের অংশ। সেখানে ইচ্ছা করলেই আমরা ঢুকতে পারি না। স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় রাতের আঁধারে তেরোঘর থেকে চোরাই পণ্য নিয়ে কেউ যদি সীমান্তের গ্রামে মধ্যে ঢুকে পড়ে, তাহলে আমাদের কতটুকুই বা করার আছে। তা ছাড়া জনবলসংকটের কারণে আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।’