ছয় ধাপ এগোল চট্টগ্রাম বন্দর

লয়েডস লিস্টের বৈশ্বিক তালিকায় ছয় ধাপ এগিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর এখন ব্যস্ততায় ৫৮তম। এক দশকে ৩০ ধাপ উন্নতি।

চট্টগ্রাম বন্দর চত্বরে কনটেইনারের সারি
প্রথম আলো

এক বছরের ব্যবধানে ছয় ধাপ এগিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দরের তালিকায় ৫৮তম অবস্থানে উঠে এসেছে। এ নিয়ে গত এক দশকে ৩০ ধাপ এগিয়েছে এই বন্দর।

২০১৯ সালে সারা বিশ্বের বন্দরগুলোর ব্যস্ততা, অর্থাৎ কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা হিসাব করে শীর্ষ ১০০টির তালিকা তৈরি করেছে লয়েডস লিস্ট। লন্ডনভিত্তিক শিপিং–বিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো এই সংবাদমাধ্যম ব্যস্ত বন্দরগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে।

পোশাকশিল্পের রপ্তানির ওপর ভর করেই চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যা বাড়ছে বলে উল্লেখ করা হয় লয়েডস লিস্টের প্রতিবেদনে। তবে অবস্থানগত উন্নতি হলেও প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারণ জরুরি বলেও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, বৈশ্বিক এই অর্জনে বন্দর ছাড়াও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বন্দর ব্যবহারকারীদের অবদান আছে। বিদ্যমান সক্ষমতা ব্যবহারের পাশাপাশি বন্দরের সম্প্রসারণ কাজও এগিয়ে চলছে। পতেঙ্গা টার্মিনাল আগামী বছরেই যুক্ত হচ্ছে। পাশাপাশি বে টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ি বন্দরের কাজও এগিয়ে চলছে। বন্দরের অবস্থানের ভবিষ্যতে আরও উন্নতি হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যত পণ্য পরিবহন হয়, তার ২৭ শতাংশ কনটেইনারে আনা–নেওয়া হয়। বাকি ৭৩ শতাংশই আনা–নেওয়া হয় কনটেইনারবিহীন সাধারণ জাহাজে। সাধারণ জাহাজের (বাল্ক, ব্রেক বাল্ক ও ট্যাংকার) খোলে আমদানি হয় মূলত সিমেন্ট, ইস্পাত ও সিরামিক কারখানার কাঁচামাল এবং পাথর, কয়লা, ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানি তেল।

পরিমাণে এক–চতুর্থাংশ পণ্য পরিবহন হলেও কনটেইনারে বেশির ভাগ শিল্পের কাঁচামাল, বাণিজ্যিক পণ্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়। আবার সমুদ্রপথে রপ্তানির পুরোটাই যায় কনটেইনারে। এতে কনটেইনার পরিবহনের সংখ্যাও অগ্রগতির পরোক্ষ সূচক হয়ে উঠছে।

লয়েডস লিস্টের তালিকায় অবশ্য বন্দরের সেবার মান বিবেচনা করা হয় না। এরপরও তালিকায় এগিয়ে যাওয়ার অর্থ হলো, বন্দরটি দিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ছে। সমুদ্রপথে দেশের কনটেইনার পরিবহনের ৯৮ শতাংশ এই বন্দর দিয়ে হয়। এতে একক বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের অবস্থানও উন্নীত হচ্ছে। এ অবস্থায় বন্দর সম্প্রসারণকাজও অনিবার্য হয়ে পড়ছে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে বন্দরে কনটেইনার পরিবহন বাড়ছে। একটিমাত্র কনটেইনার বন্দরের কারণে সব চাপ এসে পড়ছে চট্টগ্রামের ওপর। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়লে সামনে এই চাপ সামলাতে পারবে না চট্টগ্রাম। এ জন্য দীর্ঘ মেয়াদে মাতারবাড়ি বন্দর, মধ্য মেয়াদে বে টার্মিনাল এবং দ্রুত পতেঙ্গা টার্মিনাল চালুর বিকল্প নেই। মাতারবাড়ি চালু হলে বন্দরকেন্দ্রিক সর্বোচ্চ সুবিধা পাবেন ব্যবহারকারীরা।

২০১৯ সালে বিশ্বের বন্দরগুলোর গড় প্রবৃদ্ধি ছিল আড়াই শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবৃদ্ধি ছিল তার চেয়ে বেশি, প্রায় ৬ শতাংশ। পাকিস্তানের করাচি বন্দর ছিল একসময় চট্টগ্রামের আগে। দুই বছর আগেই করাচিকে পেছনে ফেলেছে চট্টগ্রাম। এখন করাচি বন্দরের ২৭ ধাপ ওপরেই আছে এই বন্দর।

লডেয়ডস লিস্টের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চীনের সাংহাই বন্দর। গত বছর বন্দরটি দিয়ে ৪ কোটি ৩৩ লাখ কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর বন্দর। সবার শেষে, অর্থাৎ ১০০তম স্থানে রয়েছে তাইওয়ানের তাইপে বন্দর। এই বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ১৬ লাখ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি বন্দর দিয়ে ৬৩ কোটি ৪০ লাখ একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছে, যা ২০১৮ সালের তুলনায় আড়াই শতাংশ বেশি। শীর্ষ ১০০ বন্দরের মধ্যে চীনের আছে ২৩টি। চীনের বন্দরগুলো দিয়ে বিশ্বের মোট কনটেইনারের ৩৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবহন হয়েছে। চীনে গত বছর কনটেইনার পরিবহন হয়েছে ২৪ কোটি ৩৭ লাখ।

বৈশ্বিক তালিকায় উন্নতি হলেও চট্টগ্রাম বন্দরে এখনো বছরের বেশির ভাগ সময় জাহাজজট লেগে থাকে। এর কারণ হলো, বন্দরটিতে সক্ষমতার চেয়ে বেশি কনটেইনার আসে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, শিল্প ও সেবা খাতে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, তার প্রতিফলন ঘটছে বন্দরের কনটেইনার পরিবহন বৃদ্ধির হারে। সামনে অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানার জন্য কাঁচামাল আমদানি ও প্রস্তুত পণ্য রপ্তানি করতে হবে। ভারতের সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহনের সুবিধাও চালু হয়েছে। তাতে কনটেইনার পরিবহন আগামী দিনে বাড়বে। এ জন্য বে টার্মিনাল চালুর বিকল্প নেই। কারণ, এখনকার অবকাঠামো দিয়ে আর বেশি কনটেইনার পরিবহনের সুযোগ নেই।